কাতার বিশ্বকাপে খেলা দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে চতুর্থ ক্ষুদ্রতম ক্রোয়েশিয়া। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা দলটি এবারও উঠে গেছে সেমি-ফাইনালে। শেষ আটে সবথেকে বড় ফেভারিট ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে হারিয়ে পরপর দুই বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত করেছে বলকান দেশটি।
সার্বিয়ার অংশ থাকাকালীন গৃহযুদ্ধ ছিল ক্রোয়েশিয়ার নিত্যসঙ্গী। এই ক্রোয়েশিয়া দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়েরাই সেই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জন্মেছেন। অনেকে সরাসরি যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছেন, তাদেরই একজন, ক্রোয়েশিয়া অধিনায়ক লুকা মদরিচ।
১৯৯০ সালে সার্বিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ক্রোয়েশিয়া, অত্যাচারি সার্বদের বিপক্ষে যুদ্ধ দেখেই বড় হয়েছেন মদরিচ। মদরিচের যখন ৬ বছর বয়স তখন তার দাদাকে হত্যা করে সার্বিয়ান আর্মি। সেই থেকে নিজের ঘর ছেড়ে পালিয়ে কখনো হোটেল, কখনো বা রিফিউজি ক্যাম্পে থেকেছেন মদরিচ ও তার পরিবার।
রিফিউজি ক্যাম্প থেকেই একদিন ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তবে তিনি যে এত বড় মাপের খেলোয়াড় হবেন আর ক্রোয়েশিয়ার সর্বকালের সেরা হিসেবে তার নাম উচ্চারিত হবে, তা নিশ্চয়ই ভাবেননি মদরিচ।
২০১৮ বিশ্বকাপে ব্যক্তিগতভাবে দুর্দান্ত খেলে দলকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে ফ্রান্সের বিপক্ষে পেরে উঠেননি। তবে মদরিচই জিতেছিলেন সেই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। ক্লাব ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জেতায় ব্যালন ডি’অর পান মদরিচ।
তার অর্জনটা কত বড় সেটি বুঝতে একটি তথ্যই যথেষ্ট। মেসি এবং রোনালদোর বাইরে ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ব্যালন ডি’অর জেতা একমাত্র খেলোয়াড় মদরিচ। কোনো ক্রোয়াট একদিন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হবেন, সেটি কী একজন ক্রোয়াটও ভেবেছিলেন?
মদরিচের পেশাদার ক্লাব ক্যারিয়ারের শুরুটা দিনামো জাগরেবে। এর আগে জাদারের যুব একাডেমিতে থাকার সময়ই নজরে পড়েন ক্রোয়েশিয়ার সবথেকে বড় ক্লাবটির। জাগরেবের একাডেমি এবং মূল দল মিলিয়ে ৮ বছর কাটানোর পর মদরিচের জীবনে আসে নতুন এক সুযোগ।ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পার্স কিনে নেয় তাকে। স্পার্সের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখাতে থাকেন তরুণ মদরিচ, খ্যাতিও পেয়ে যান ‘বলকান ক্রুইফ’ হিসেবে। স্পার্সের হয়ে ৪ বছর খেলার পর তার জীবনে আসে সবচেয়ে বড় বাঁকটি।
বিশ্বের সবথেকে বড় এবং সফল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন মদরিচ। সেই থেকে তাদের সাফল্যের নিত্যসঙ্গী এই ক্রোয়াট মিডফিল্ডার। রিয়ালের হয়ে জিতেছেন ৫টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। যার সর্বশেষটি গত মৌসুমেই।অথচ রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার পর সেই মৌসুমের সবথেকে বাজে সাইনিং হিসেবে আখ্যা পেয়েছিলেন লুকা মদরিচ।
কিন্তু যার রক্তে-রন্ধ্রে মিশে আছে যুদ্ধ, যার জীবনই ছিল অনিশ্চিত, সেই বলকান রূপকথার রাজা তো আর সহজে হার মানার পাত্র নন। ভস্ম থেকে উঠে আসার অভিজ্ঞতা কিংবা সামর্থ্য দুটোই যে মদরিচের জীবনের মন্ত্র।ক্রোয়েশিয়ার পতাকা সর্বোচ্চ চূড়ায় তুলে ধরতে পারলেই এখন পূর্ণতা পাবে মদরিচের ক্যারিয়ার। যদি তিনি ব্যর্থও হোন, ক্রোয়াট ফুটবল কিংবা মানুষের মনে তার জায়গা কমবে না এতটুকুও।
শেয়ার করুন