মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার:
আল্লাহ তা’য়ালার অমিয় বাণী: ‘প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।’ পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী আর মৃত্যু এক অনিবার্য বাস্তবতা। মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু একদিন সবাইকে মরতে হবে সে বিষয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোন মতপার্থক্য নেই। ‘মৃত্যু’ পৃথিবীর মায়ামোহ, ধন-দৌলত থেকে সবাইকে বিচ্ছিন্ন করে। ভাই-বোন, পিতা-মাতা কিংবা বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্কের মাঝে ফারাক তৈরি করে। প্রেম-ভালোবাসার বন্ধনকে ছিন্ন করে। এমনকি এক পর্যায়ে মৃত ব্যক্তিকে তাদের স্বজন কিংবা পরিচিত জনের হৃদয় থেকে ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু মৃতকে বাঁচিয়ে রাখে একটি মৃত্যু। সেই মৃত্যু সৌভাগ্যের, সেই মৃত্যু শাহাদাতের। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদরেকে মৃত বলো না। এসব লোক প্রকৃতপক্ষে জীবিত, কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।’ কবির ভাষায়: ‘জীবনের চেয়ে দৃপ্ত মৃত্যু তখনি জানি/শহীদী রক্তে হেসে উঠে যবে জিন্দেগানী’।
‘সত্য মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের/খোদার রাহে প্রাণ দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের।’ ছোটবেলা থেকেই যার হৃদয়ে ইসলামের প্রতি অনুরাগ ছিলো। যার চিন্তা-চেতনায় ছিলো আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর রাসূল (সা.)-এর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা। যার জীবনের পদক্ষেপগুলো ছিলো জান্নাতি পথে। তিনি এক আদর্শ তরুণ। মেধা আর চরিত্রের অতুলনীয় সমন্বয় ছিলো যার জীবনে, তার নাম শহীদ আব্দুল করীম।
শহীদ আব্দুল করীম সিলেট জেলার কানাইঘাট থানার ঘড়াই গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের ২১ জুন পিতা আব্দুল কুদ্দুছ আর মাতা সিদ্দিকা বেগমের ঘরে জন্ম হয় আলোকিত এই তরুণের। ৪ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তিনি তাঁর গ্রামের স্কুল মানিকগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি সিলেট নগরীর দ্য এইডেড হাইস্কুলে ভর্তি হন। এক সময় স্কুলের সকল বিভাগের ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ায় তাকে তৎকালীন জেলা প্রশাসকসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে শ্রেষ্ঠ ছাত্র ঘোষণা করে পুরস্কৃত করা হয়। ১৯৯০ সালে একই স্কুল থেকে এসএসসি বিজ্ঞান শখায় প্রথম বিভাগে এবং ১৯৯২ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। একই কলেজে দর্শনবিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
৮ ডিসেম্বর ১৯৯৫ সাল। রাত সাড়ে ১০টা। সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন তথা সদস্য সম্মেলনের কালেকশন শেষ করে সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার কদমতলী বাসায় ফেরার পালা। সংগঠনের সদস্য ও তৎকালীন ১০ নং ওয়ার্ড (উপশহর) সভাপতি আব্দুল করীম অন্যান্য দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। শাহজালাল ব্রিজের দক্ষিণ পার্শ্বে ওভার ব্রিজের ওপর আসার পর ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন বিরোধী চক্র চড়াও হয় তার ওপর। সন্ত্রাসীচক্রের নৃশংস হামলায় নিথর হয়ে যায় তার গোটা দেহ। রক্তাক্ত আর ক্ষত-বিক্ষেত লাশ পাওয়া যায় সেখানে। শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন আমাদের প্রিয় সেই দায়িত্বশীল।
শহীদ আব্দুল করীম ছিলেন আদর্শ জীবনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও পরিশ্রমী ছিলেন। তাঁর সহজ-সরল জীবনযাপন সবাইকে উদ্দীপ্ত করতো। পায়ে হেঁটে কিংবা রিকশায় চড়ে ইসলামী আন্দোলনের কাজ করতে তিনি পছন্দ করতেন। সাদামাটা পোশাক-পরিচ্ছদ ছিলো তার নিত্যসঙ্গী। সংগঠনের প্রতি আন্তরিকতা আর কর্তব্যের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতা অতুলনীয় ছিলো।
শহীদ আব্দুল করীম সবসময় শাহাদাতের তামান্না অন্তরের মাঝে লালন করতেন। তিনি মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের কাছে সবসময় বলতেন- ‘আমার বড় সাধ, আল্লাহর পথে শহীদ হই’। শাহাদাতের দিন জুম’আর নামাজের পর এক প্রতিবেশীর কথার জবাবে তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, শাহাদাত আমার কামনা’। মাকে বলতেন, ‘মা আমি যদি শহীদ হই, তুমি কেঁদো না। কেননা তুমি হবে শহীদের গর্বিত জননী।’ তিনি তার কথাবার্তা কিংবা বক্তৃতায় প্রায়শই বলতেন, ‘যারা শাহাদাতের জযবা নিয়ে এগিয়ে চলে, বাঁধার ব্যারিকেডগুলো তাদের কুর্নিশ করে।’ শহীদ আব্দুল করীম বিদায়ের কিছুদিন পূর্বে তার ডায়রিতে লিখেছিলেন; ‘অলসতা আমার শত্রু, পরিশ্রমপ্রিয়তা আমার বন্ধু।’ তিনি সেই আলোকে তাঁর জীবনটাও পরিচালনা করার চেষ্টা করতেন।
সাত নভেম্বর ২০১১ ইং। ঈদের দিনে শহীদ আব্দুল করীম ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। শহীদের সম্মানিত পিতা ও বড় দুই ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। শহীদের পিতার সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হলো। তিনি শুরু থেকে আমাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি। কান্নারত অবস্থায় কাঁপা কণ্ঠে তিনি আবার কথা বলতে শুরু করেন। আবেগ জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার আব্দুল করীম প্রায় ষোল বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো। অথচ তোমরা আজও আমায় স্মরণ করো, দেখতে আসো। শহীদের পিতা না হলে এরকম আন্তরিকতা, ভালোবাসা হয়তো কখনই পেতাম না। আল্লাহ পাকের শুকরিয়া তিনি আমাকে শহীদের গর্বিত পিতা হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, কিয়ামতের ময়দানে যদি মহান মনিব আমাকে শহীদের পিতা হিসেবে জান্নাতের বাসিন্দা হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন, তাহলেই আমার জীবন সার্থক। তিনি আরও বলেন, তোমরা আমার আব্দুল করীমের মতোই। তোমাদের চেহারায় আমি আমার আব্দুল করীমকে খোঁজে পাই। শহীদ আব্দুল করীম শাহাদাতের জন্য ব্যাকুল ছিলো। দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে তাঁর মতো আন্তরিক খুব কম লোকই হতে পারে। এক পর্যায়ে তিনি আর কথা বলতে পারলেন না। অসুস্থতাবোধ করায় তাকে বিশ্রামে রেখে আমরা চলে আসি। যতদিন শহীদ আব্দুল করীম ভাইয়ের শ্রদ্ধেয় পিতার সাথে সাক্ষাৎ করেছি, সবসময়ই তাকে এরকম আবেগাপ্লুত পেয়েছি। শ্রদ্ধেয় চাচার কান্না দেখে মনে হতো শহীদ আব্দুল করীম যেন গতকাল কিংবা আজই শাহাদাত বরণ করেছেন।
[বিঃদ্রঃ লেখাটি- ছাত্র সংবাদ, ডিসেম্বর-২০১১ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিলো। একসাথে দু’জন শহীদকে নিয়ে লেখা হয়। শহীদ আব্দুল মু’নিম বেলাল ভাইকেও স্মরণ করা হয়। তিনি ১৯৯৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর শাহাদাতবরণ করেছিলেন।]
শেয়ার করুন