শাল্লার ইউএনও মুক্তাদির আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ অনিয়মে দন্ডিত

সুনামগঞ্জ

মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে অনিয়মের দায়ে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার আলোচিত সেই নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আল-মুক্তাদির হোসেনকে দন্ডিত করা হয়েছে। শাস্তি হিসেবে তার ‘বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি দুই বছরের জন্যে স্থগিত’ রাখার লঘুদণ্ড প্রদান করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম ওই শাস্তির আদেশে সইও করেছেন। আগামীকাল রোববার এবিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শৃংখলা ও তদন্ত অনুবিভাগ) ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ গতকাল শুক্রবার রাতে সিলেটের ডাককে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন,“তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ইতোমধ্যে শাস্তির আদেশে সই হয়ে গেছে। রোববার এটির প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে”।

পাহাড়সম অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি ইউএনও আল-মুক্তাদিরকে শাল্লা থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে বান্দরবানে বদলি করা হয়। বর্তমানে তিনি জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটের (এনআইএলজি) উপপরিচালক পদে কর্মরত আছেন। গতরাতে একাধিকবার বক্তব্য জানতে চেয়ে দন্ডিত কর্মকর্তা আল-মুক্তাদির হোসেনের ব্যক্তিগত সেল ফোনে কল দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি!

জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের করা বিভাগীয় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামলাটির তদন্ত করে সম্প্রতি প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত কর্মকর্তা ১৬ লাখ ৯৯ হাজার ৩২০ টাকা ফেরত প্রদান করা না হলেও অভিযুক্ত কর্মকর্তা কর্তৃক আত্মসাত করাও হয়নি বরং উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্ষার পানি হতে নির্মিত ঘরসমূহ রক্ষার জন্য প্রটেকশন ওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। বিধায় তার বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতিপরায়ণতা’-এর অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। তবে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩ (খ) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৩ (খ) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় একই বিধিমালার ৪(২)(খ) বিধি অনুযায়ী তার ‘বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি দুই বছরের জন্যে স্থগিত’ রাখার লঘুদণ্ড প্রদান করা হলো। তিনি দুই বছরের বর্ধিত বেতন কখনও প্রাপ্য হবেন না। দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তৃতীয় বছর হতে তিনি বর্ধিত বেতন প্রাপ্য হবেন মর্মে নির্দেশ প্রদান করা হলো। এ প্রতিবেদনে দেয়া সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে তাকে শাস্তি হিসেবে দন্ডিত করা হয়।

এর আগে গত বছর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আল-মুক্তাদির হোসেন ২০১৮ সালের ১২ নভেম্বর থেকে শাল্লা উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্মরত থাকাকালে মুজিববর্ষ উপলক্ষে শাল্লা উপজেলায় ১ম পর্যায়ের বরাদ্দকৃত ১ হাজার ৪৩৫টি ঘরের মধ্যে ১৮২টি ঘরের জমি নির্বাচন সঠিকভাবে না করায় ভূমি বন্দোবস্ত নিয়ে জটিলতা তৈরী হয়েছে। যার মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূমিতে ১৮টি ঘর, সম্পূর্ণ ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গায় ৫টি ঘর, পূর্বে বন্দোবস্তকৃত জায়গায় ১৫৩টি ঘর এবং পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলার চরহবিপুর মৌজার ব্যক্তিমালিকাধীন ভূমিতে ৬টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পে ঘর নির্মাণের সময় ১৪০টি ঘর ডিজাইন বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়। ডিজাইন পরিবর্তন করে ১৪০টি ঘর নির্মাণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত না করা, উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্থান সংকুলানের অভাবে ঘরের ডিজাইন পরিবর্তন করে ১৪০টি ঘর নির্মাণ করে প্রতিটি গৃহ নির্মাণে ১২ হাজার ১৩৮ টাকা করে কম খরচ হয়েছে মর্মে কারিগরি কমিটির আহ্বায়ক, নির্বাহী প্রকৌশলী, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-সুনামগঞ্জ এর ২৭ জুন ২০২১ তারিখের ১৮০৫ নং স্মারকে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকলেও তিনি এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক কর্তৃক কারণ দর্শানোর জবাবে কিছু উল্লেখ না করা এবং ডিজাইন ব্যত্যয়ের কারণে সাশ্রয়কৃত টাকা (প্রতিটি ঘর ১২ হাজার ১৩৮ টাকা হিসাবে ১৪০ টি ঘরের জন্য ১৬ লক্ষ ৯৯ হাজার ৩২০ টাকা) সরকারি খাতে ফেরত প্রদান না করার কারণে এ মন্ত্রণালয়ের ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের ০৫.০০.০০০০.২৭.০১৯.২১(বি.মা)-৩৩৪ সংখ্যক স্মারকে তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৩(খ) ও ৩(ঘ) অনুযায়ী যথাক্রমে ‘অসদাচরণ ও দুর্নীতিপরায়ণতা’ এর অভিযোগে বিভাগীয় মামলা রুজু করে কৈফিয়ত তলব করা হয়। একই সাথে কেন তাকে চাকরি হতে বরখাস্ত বা অন্য কোন উপযুক্ত দণ্ড প্রদান করা হবে না তা অভিযোগনামা প্রাপ্তির ১০ (দশ) কার্য দিবসের মধ্যে জানানোর জন্য এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি ব্যক্তিগত শুনানি চান কিনা তা তার লিখিত জবাবে উল্লেখ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। অভিযুক্ত কর্মকর্তা অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণীর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর লিখিত জবাব দাখিলপূর্বক ব্যক্তিগত শুনানির জন্য আবেদন করলে ওই বছরের ১৪ অক্টোবর ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহণপূর্বক ন্যায় বিচার ও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, শাল্লা উপজেলায় হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনে অনিয়ম হয়েছে বলে উপজেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা জেলা প্রশাসকের নিকট লিখিত অভিযোগ দেন। চেয়ারম্যানদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বিষয়টির তদন্ত করতে সুনামগঞ্জের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেনকে প্রধান এবং পাউবোর সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের দুজন প্রকৌশলীকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। পিআইসি নিয়ে নজিরবিহীন ওই অভিযোগের পরপরই তাকে শাল্লা থেকে স্ট্যাণ্ড রিলিজ করা হয়।

ইউএনও আল মুক্তাদির হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। শাল্লায় যোগদানের পর পিআইসি নিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ ওঠে। এরপর ঘর নির্মাণসহ ওঠে অসংখ্য অভিযোগ। ঘর নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ পেয়ে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরকে সাথে নিয়ে শাল্লার সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহ পরিদর্শন করেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ৩ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও ২০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাথে নিয়ে শাল্লায় তদন্তে যান তিনি। ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি সিলেটের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান এনডিসি, জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকগণসহ ২৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওখানকার নির্মাণাধীন প্রত্যেক ঘরে ঘরে যান। এরপর আরও দুই দফায় জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ ২৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাল্লা উপজেলায় সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত করেন। সর্বশেষ ১৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরেজমিনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনিয়ম যাচাই করেন। তাদের কাছে নানাবিধ ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়ে। ইউএনও আল-মুক্তাদিরকে ওই সময় ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা সুবিধাভোগীদের নিকট দিতে বাধ্য করা হয়।

শাল্লা উপজেলার বাসিন্দা দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলার গোপালপুর গ্রামের ৩ পরিবারকে অবৈধ পন্থায় ঘর দেয়া হয়। শাল্লা উপজেলায় নির্মিত ৩টি গ্রামের ২৫টি ঘরে দেখা দেয় ফাটল। ঘর নির্মাণ কাজের শুরু থেকে নানাবিধ অনিয়মের কারণে এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত উপজেলা মৎস্য অফিসার মামুনুর রহমানকেও বান্দরবনে বদলি করা হয়। আর ইউএনও আল-মুক্তাদিরকে দেয়া হয় কারণ দর্শানোর নোটিশ।

প্রকল্প এলাকার ঘরের কাজ শেষ হতে না হতেই বেশ কিছু ঘরে বড় বড় ফাটল দেখা দেয়। ব্যবহারের আগেই কোনো কোনো ঘরের রান্নাঘর ও বাথরুমের অংশ ধসে পড়ে। খসে পড়ে দরজা জানালাও। উপজেলার ভেড়াডহর, আটগাঁও, মুজিবনগর, সেননগরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের এমন দৃশ্য দৈনিক সিলেটের ডাকসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তোলপাড় শুরু হয়। ঠিকাদারদের পাওনা অর্থও পরিশোধ করেননি ইউএনও মুক্তাদির। এজন্যে ভুক্তভোগী ঠিকাদাররা সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারের নিকট লিখিত অভিযোগও দেন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *