শাসকের দায়িত্ব এবং স্বৈরাচারদের পরিণতি

ইসলাম ও জীবন

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে মানবসভ্যতা। আর সামাজিক সুশাসন ও শৃঙ্খলার ওপরই নির্ভর করে মানুষের সার্থকতা। শুধু দল বেঁধে বাস করলেই সমাজ হয় না। প্রত্যেক মানুষ একে অপরের কল্যাণের কথা ভেবে সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিয়ম ও শৃঙ্খলার অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাস করলে সেই জনগোষ্ঠীকে সমাজ বলে। এই সমাজকে বাঁচিয়ে রাখা, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজ বা রাষ্ট্রে থাকে ‘শাসক’। কারণ, একেক মানুষের চিন্তাভাবনা, স্বভাব-চরিত্র একেক রকম। ফলে তাদের মধ্য থেকেই নিয়ন্ত্রক বা কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়া সমাজে সংঘর্ষ লাগা খুব স্বাভাবিক। এ জন্য প্রয়োজন নেতা ও শাসক।

সরকার জনগণের জিম্মাদার

নিরপেক্ষভাবে অধীনের অধিকার আদায়ে কাজ করা এবং জনগণের জান-মালের হেফাজত করা শাসকের মৌলিক দায়িত্ব ও প্রধান কর্তব্য। এ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সুতরাং জনগণের শাসকও একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুরুষ তার পরিবারের একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাবাদ করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘর-সংসার ও সন্তানের দায়িত্বশীল, তাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গোলাম তার মনিবের মাল-সম্পদের দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (বুখারি : ২৫৫৪)

ন্যায়পরায়ণ শাসকের পুরস্কার

যারা ন্যায় ও সততার সঙ্গে ক্ষমতা ও পদের সঠিক ব্যবহার করেন, আখিরাতে তাদের মহাপুরস্কারে ভূষিত করা হবে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন : ‘ন্যায়-নীতিবান বিচারক কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে তার ডান পাশে দ্যুতিময় মিম্বরে অবস্থান করবেন। অবশ্য আল্লাহতায়ালার উভয় পাশই ডান। তারা হলো সেসব বিচারক বা শাসক, যারা নিজেদের বিচার-বিধানে, নিজেদের পরিবার-পরিজনে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।’ (মুসলিম : ১৮২৭)

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন লোকদের মাঝে ন্যায়নিষ্ঠ শাসকই আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে প্রিয় ও কাছে উপবেশনকারী হবে।’ (তিরমিজি : ১৩২৯)

স্বৈরাচারদের ভয়াবহ পরিণতি

ন্যায়পরায়ণ শাসকদের জন্য যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট প্রতিদান রয়েছে, তেমনি স্বৈরাচারী শাসকদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ পরিণতি ও কঠিন আজাব। মহান আল্লাহ যুগে যুগে স্বৈরশাসকদের পাকড়াও করেছেন। যারা নিজেদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ভেবেছিল, ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল এবং জনগণের ওপর জুলুম করেছিল। বিশ্ববাসীর জন্য মহান আল্লাহ দুনিয়াতেই এমন কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। যাতে পরবর্তীরা তা থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি কারুন, ফিরাউন ও হামানকে ধ্বংস করেছিলাম। মুসা তাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শন নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারা ভূপৃষ্ঠে দম্ভ করল, তারা আমার শাস্তি এড়াতে পারেনি। তাদের প্রত্যেককেই আমি তার পাপের কারণে পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড ঝটিকা, কাউকে আঘাত করেছিল মহানাদ, কাউকে আমি ধসিয়ে দিয়েছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোনো জুলুম করেননি; তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল।’ (সুরা আনকাবুত : ৩৯-৪০, ৪৩)

ক্ষমতা গ্রহণের পর যারা স্বৈরাচারী হবে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, তাদের জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। ইহকালেও নেমে আসতে পারে যেকোনো বিপদ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো বান্দাকে আল্লাহ যদি জনগণের নেতৃত্ব প্রদান করেন, আর সে যদি কল্যাণ কামনার সঙ্গে তাদের তত্ত্বাবধান না করে, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (বুখারি : ৭১৫০)

অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি মুসলিম জনসাধারণের দায়িত্ব লাভ করল আর তার মৃত্যু হলো খিয়ানতকারী হিসেবে, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (বুখারি : ৭১৫১)

একদা আমর ইবনু মুররা (রা.) মুআবিয়া (রা.)-কে বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘গরিব-মিসকিন ও নিজ প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে আগমনকারী লোকের জন্য যে নেতা নিজের দরজা বন্ধ করে রাখে, তার দারিদ্র্য, অভাব ও প্রয়োজনের সময় আল্লাহতায়ালাও আকাশের দরজা বন্ধ করে রাখবেন।’ এ কথা শোনার পর থেকে মুআবিয়া (রা.) এক লোককে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করেন। (তিরমিজি : ১৩৩২)

তাই অধীনের দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি প্রকাশ করা ও তাদের প্রতি ইনসাফ করা অত্যাবশ্যক। কারণ শাসক যখন জুলুম-অত্যাচার শুরু করে, তখন তার ওপর থেকে আল্লাহর সাহায্যের হাত উঠে যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে পর্যন্ত বিচারক কোনো ধরনের জুলুম না করে, সে পর্যন্ত আল্লাহ তার সহায়ক হন। সে যে মুহূর্তে কোনো ধরনের জুলুম করে, তখন আল্লাহ তাকে পরিত্যাগ করেন এবং শয়তান তাকে জড়িয়ে ধরে।’ (তিরমিজি : ১৩৩০)

লেখক : আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগীয় প্রধান, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, গুলশান, ঢাকা

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *