তুরাব হত্যার তিনমাসেও আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত কাযর্ক্রম। গ্রেফতার হয়নি কোনো আসামি। একাধিকবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তার হাত বদলের সাথে সাথে হয়েছে তদন্ত ইউনিটেরও বদল। কিন্তু বদল হয়নি শুধু মামলার ভাগ্যের। তাই সাংবাদিক তুরাব হত্যাকান্ডের তিনমাস পেরিয়ে গেলেও এই সময়ের মধ্যে গ্রেফতার হয়নি কোন আসামি। তুরাব হত্যায় দায়ের করা মামলায় আসামিদের বেশির ভাগই পুলিশ সদস্য। আসামিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন সাংবাদিক তুরাবের পরিবার-পরিজন। তারা মামলার ধীরগতি ও আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত রয়েছেন। পরিবারের দাবি অবিলম্বে তুরাব হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেফতার ও তাদের শাস্তি যেন নিশ্চিত করা হয়।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর নগরীর বন্দরবাজারে গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক এটি এম তুরাব। ওই দিন পুলিশের গুলিতে তিনি মারাত্মক আহত হন। পুলিশের ছোড়া কয়েক টি বুলেট ঢুকে তার শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
পরবর্তীতে তাকে সোবহানী ঘাট ইবনে সিনা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা পৌনে ৭ টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানেই মারা যান তুরাব। নিহত তুরাব দৈনিক নয়া দিগন্তের জেলা প্রতিনিধি ও স্থানীয় দৈনিক জালালাবাদের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন।
তুরাব হত্যার পর তার ভাই আবুল হাসান মো. আজরফ (জাবুর) কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি পুলিশ জিডি হিসেবে গ্রহণ করে।এতে অনেকটা ক্ষুদ্ধ হন তুরাবের পরিবারের লোকজন। জিডি প্রসঙ্গে এসএম পির তৎকালীন উপ পুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ জানিয়ে ছিলেন তুরাবের পরিবারের জিডি পুলিশের দায়ের করা মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তদন্ত করা হবে।
পরবর্তীতে ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। সরকার পরিবর্তন হলে ১৯ আগষ্ট আদালতেএকটি মামলা করেন তুরাবের ভাই আবুল হাসান মো. আজরফজাবুর।
মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (ক্রাইম, উত্তর) মো. সাদেক দস্তগীর কাউছার, উপকমিশনার (উত্তর) অতিরিক্ত ডিআইজি আজবাহার আলী শেখ সহ ১৮ জনের নাম উল্লেখ এবং ২৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহা নগর হাকিম আদালতের বিচারক আব্দুল মোমেনের আদালতে মামলাটি করা হয়। আদালত মামলাটি এফ আই আর মূলে গ্রহণের আদেশ দেন।
মামলায় আরো যাঁদের নাম উলেখ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন এসএমপির কোতোয়ালি থানার সহকারী কমিশনার (এসি) মিজানুর রহমান, বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কলোল গোস্বামী, কোতোয়ালি থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন, পরির্দশক (তদন্ত) ফজলুর রহমান, এস আই কাজী রিপন আহমদ, মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগ সভাপতি আপ্তাবউদ্দিন, জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সহসভাপতি পীযূষকান্তি দে, সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর র“হেল আহমদ, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সজল দাস অনিক, শিবলু আহমদ, সেলিম মিয়া, আজহার, ফিরোজ ও উজ্জ্বল।
নিহত তুরাবের বড় ভাই বলেন, ‘পেশাগত দায়িত্ব পালন কালে তাঁর ভাইকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পর থানায় মামলা করা হলেও পুলিশ এটিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালতে শরণাপন্ন হয়েছি । মামলা তিনমাস পেরিয়ে গেল কিন্তু এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। ভাই হত্যার বিচার চেয়ে বলেন, ইচ্ছা ছিল আইন ও স্বরাষ্ট উপদেষ্ঠদের সঙ্গে দেখা করার। বিষয়টা তাদের খুলে বলব। এস,এম,পি কমিশনার মোঃ রেজাউল করিম বলেন- সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই আমরা কাজ করছি। দোষী যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। ৫ আগষ্ট পরবর্তী পুলিশ কিছুটা মানসিকভাবে বিপর্য্স্ত ছিল্ । ধীরে ধীরে সবাই সক্রীয় হচ্ছে। আশা করি দ্রুত একটা পর্যায়ে পৌছাব।
ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ও ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাস পাতালের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শামসুল ইসলাম জানান, ইতিমধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে ময়না তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে। রিপোর্টে বুলেটের আগাতেই তার মৃত্যু হয়েছে এটা উল্লেখ আছে। তিনি জানান, নিহতের শরীরে ছিল ৯৮ টি আঘাতের চিহ্ন। গুলিতে তার লিভার ও ফুসফুস আঘাত প্রাপ্ত হয়। মাথায় ঢিলের আঘাতও ছিল।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই-ইন্সপেক্টর মুরসালিন-জানান, আমরা ৮ অক্টোবর মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। বাদী এবং স্বাক্ষী দুই এক জনের সাথে কথা হয়েছে। আমি তাদের অনেককে বলেছি ঘটনার মুল ভিডিওটি দেওয়ার জন্য। আমাদের কাছে যে ভিডিওটি রয়েছে তা এডিট করা এবং জোড়া তালি দেওয়া তাই ঘটনার সাথে সম্পৃক্তদের খুজে বের করতে একটু সময় লাগছে। তাছাড়া ৫ আগষ্টের পর থেকে পুলিশ কার্য্ক্রম পুরোপুরি সক্রিয় না হওয়া টাও মামলা তদন্তে বিলম্বের একটি কারন। এছাড়াও ঘটনার শুরুতে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয় যেখানে ঐ মামলার বাদী সাব-ইন্সপেক্টর কল্লোল গোস্বামী বর্তমান মামলায় আসামি। বর্তমানে উভয় মামলার তদন্তই আমার দায়িত্বে রয়েছে। আমি যখনই কাউকে ডিমান্ড করবো আইনের আওতায় আনার জন্য । তখন তার বিরুদ্বে এভিডেন্স দাড় করাতে হবে। আমাদের আইনি প্রক্রিয়া অনুসরন করে কাজ করতে হয়। আইনি প্রক্রিয়া যথাযথ অনুসরন না করলেও সমস্যা।ঘটনার সাথে কার কি ভুমিকা তা এসেসমেন্ট করতে হয়। আমরা আমাদের সর্বাত্বক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশাকরি খুব শীঘ্রই আমরা সুখবর দিতে পারব্ ো। তবে মামলায় যেই দোষী হোক না কেন তাদের কে আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইনজীবি সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহীন বলেন-যেহেত্ ুএজাহারে আসামিদের বিস্তারিত দেওয়া আছে তাই পুলিশ চাইলে আসামিদের ব্যাপারে এতদিনে অনুমতি নেওয়ার পক্রিয়া শেষকরতে পারতো।
আইন অনুসারে সরকারী কোন কর্মকর্তাকে গ্রেফাতারে পূর্বে প্রয়োজন, তার বিরুদ্ধে অপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমান প্রতিষ্টিত করা এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ। তার পরই মিলবে গ্রেফতারের অনুমতি। আইনের এমন ষোল কলা পূর্ণকরতেই অপরাধীদের কেউ চলে যায় নিরাপদ আশ্রয়ে। আবার কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি মঈন উদ্দীন শীপন আটক হয়েও ছাড়া পেয়ে যায় সহজে। তাই সাংবাদিক নেতাদের পুলিশকমিশনার অফিস ঘেরাও বা লাগাতোর আন্দোলনেও আসামিরা গ্রেফতার হচ্ছে না। এখন সবার চোখ তুরাব হত্যার নতুন ভাবে দায়িত্ব পাওয়া পিবিআই কর্মকর্তাদের দিকে। স্বজনদের চিন্তা তুরাবের আসামিরা কি গ্রেফতার হবে, না কি শুধু আদালতে ধর্ণা দিতে হবে।
শেয়ার করুন