সিলেট নগরজুড়ে চলছে উন্নয়নযজ্ঞ। কিন্তু মিলছে না উন্নয়নের কাক্সিক্ষত সুফল। সংকট সমাধানের চেয়ে আরও প্রকট হচ্ছে। কিন্তু কেন? সিলেটভিউয়ের পক্ষ থেকে এর কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্থপতি রাজন দাসের কাছে।
চোখ বন্ধ করে এই স্থপতি বললেন, ‘প্ল্যানিং প্রবলেম। কোন কাজেই পরিকল্পনা নেই। নগর কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছেমাফিক কাজ করছে। আগপিছ না ভেবেই তারা উন্নয়ন কাজ করছে। যে কারণে সমস্যা সমাধানের চেয়ে আরও বাড়ছে। নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসা-বাড়ি ভেঙে প্রশস্ত করা হচ্ছে রাস্তা। জনস্বার্থ বিবেচনায় অনেকেই কোটি টাকা মূল্যের জায়গা ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু এরপরও কমছে না যানজট। এর কারণ হিসেবেও স্থপতি রাজন দাস দায়ি করেন অপরিকল্পিত উন্নয়নকে।
তিনি বলেন, “একটি পুরনো শহরের রাস্তাঘাট হুট করেই চাহিদামতো প্রশস্ত করা যায় না। এজন্য পুরনো রাস্তাকে বহাল রেখে বিকল্প চিন্তা করতে হয়। একটি সড়কের কী পরিমাণ যান চলাচলের সক্ষমতা আছে সেটি দেখতে হয়। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সাথে পরিকল্পনা শেয়ার করতে হয়। কিন্তু সিলেট সিটি করপোরেশন কোন ধরণের গবেষণা ও পরিকল্পনা ছাড়াই মানুষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা-বাড়ি ভেঙে রাস্তাঘাট প্রশস্ত করছে। রাস্তার উভয় পাশে তিনফুট করে প্রশস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু তিনফুট প্রশস্ততায় যানবাহন চলাচলের জন্য নতুন কোন লেন তৈরি সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন অন্তত ৮ ফুট জায়গা। ফলে রাস্তা কিছুটা প্রশস্ত হলেও যানজট কমছে না।”
জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন যেসব কাজ করেছে তা হিতে বিপরীত ডেকে এনেছে বলে মনে করেন স্থপতি রাজন দাস। তিনি মনে করেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন এখন পর্যন্ত যে ব্যয় করেছে সেটি পরিকল্পিতভাবে হলে নগরবাসীর দুর্ভোগ কমতো। কেবলমাত্র ছড়া-খাল খনন আর নতুন ড্রেন নির্মাণ করে জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব নয় বলে মনে করেন রাজন।
তিনি বলেন, “সিলেট নগরীর উত্তরাংশ উঁচু, টিলাবেষ্টিত। ছড়া-খালগুলো সেখান থেকেই উৎপত্তি হয়েছে। আবার দক্ষিণ অংশ অর্থাৎ সুরমা তীরবর্তী এলাকা অপেক্ষাকৃত নিচু। উত্তরাংশ থেকে উৎপত্তি হওয়া ছড়া-খাল দিয়েই নগরীর পানি গিয়ে সুরমায় পড়ে। এজন্য ছড়া-খাল খনন কিংবা ড্রেন নির্মাণে কোথায় কী পরিমাণ গভীরতা ও প্রশস্ততা হবে সেটা গবেষণার বিষয়, পরিকল্পনার বিষয়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের কোন সার্ভে নেই, পরিকল্পনা নেই। তারা টাকা পেলেই প্রকল্প তৈরি করে কাজ করছে। যে কারণে টাকা খরচ হয়, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না।”
জলাবদ্ধতার কারণ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রাজন দাস বলেন, “সিলেট বৃষ্টিবহুল অঞ্চল। এখানে সবসময়ই ভারী ও বেশি পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু এক দশক আগেও সিলেটে এতো ব্যাপকভাবে জলাবদ্ধতা হতো না। ভারী বর্ষন হলে নিচু এলাকায় সাময়িক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো। এখন বৃষ্টি হলে পুরো নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকার লোকজনও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পান না। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত কর্মকান্ড।”
তিনি আরও বলেন, “সিটি করপোরেশনের কোনো মাস্টারপ্ল্যান নেই। কোনো কাজের জন্য কী করতে হবে? উন্নয়নের স্থায়িত্ব কত বছর হবে, সেটা নিয়ে তাদের না আছে কোনো গবেষণা, না আছে কোনো পরিকল্পনা। যে কারণে ইচ্ছেমাফিক কাজ হয়, আর ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীতে যেসব ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোর স্লোভই ঠিকমতো হয়নি। কোথায় কী পরিমাণ স্লোভ রাখতে হবে সেটা নিয়ে আগেভাগে তারা কোন পরিকল্পনা নেননি। তাই বৃষ্টি হলে বিভিন্ন স্থানে পানি আটকে থেকে ড্রেন উপচে পানি বাসা-বাড়িতে উঠে পড়ে।”
শেয়ার করুন