সিলেটে দুই বছরে ৩৮ নারী হত্যা

সিলেট

সিলেটে দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে হত্যাকান্ড।হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছেন শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা।ছাড় পাচ্ছে না নারীরাও।গত দুই বছরে সিলেট বিভাগের প্রতিটি জেলায় বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা। দুই্ বছরে এই অঞ্চলে সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৮নারী। এরমধ্যে সর্বশেষ ২০২২ সালে চার জেলায় হত্যার শিকার হয়েছেন ২৮জন ও ২০২১ সালে ১০ নারী হত্যার শিকার হয়েছিলেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন; পারিবারিক কলহের কারণে বেশিরভাগ নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। সেই সাথে আর্থিক সংকট, অভাব অনটনের বিষয়েও এক পর্যায়ে নারীকে হত্যা করা হচ্ছে।নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি করতে হবে।পাশাপাশি দ্রুত ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

জানা যায়, ২০২০ সালে স্বামীর হাতে ৪ নারী ও ২০২১ সালে ৮ নারী খুন হন। আর গেলো বছর নারীর নিরাপদ ঠিকানা খোদ স্বামীর হাতেই নিহত হয়েছেন ১১ জন। আর নিজের গর্ভে ধারণ করা পুত্রের হাতে খুন হয়েছেন ২ মা। গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে ৪ জনকে।এক নারীকে জবাই করে লাশটি ৬ টুকরো করার মতো বীভৎস ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় সর্বোচ্চ ১১ জন, সিলেট জেলায় ১০ জন, হবিগঞ্জ জেলায় ৬ জন এবং মৌলভীবাজার জেলায় ১ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। একই সময়ে ৫ শিশু হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।

আরও জানা গেছে, সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের উত্তর মহাইল গ্রামে ২৩ জানুয়ারি মা আয়নব বিবি (৬০)-কে তার পুত্র আবুল হাসনাত হত্যা করে। দক্ষিণসুরমা উপজেলার জালালপুরের হাসামপুরে ২৫ জানুয়ারি স্বামীর পরিবারের নির্যাতনে শিল্পী বেগম (২৬) নামের গৃহবধূ খুন হন।

নবীগঞ্জের রসুলগঞ্জ বাজারে ১ ফেব্রুয়ারি রাজনা বেগম (১৮) নামের গৃহবধূর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। হাত-পা বেঁধে রাজনাকে হত্যা করে ঘাতক স্বামী জাকারিয়া পালিয়ে যায়।৭ ফেব্রুয়ারি দোয়ারাবাজারে মহিলাদের ঝগড়া থামাতে গিয়ে গোলেস্তা বেগম (৭৫) নিহত হন।

জগন্নাথপুর পৌর পয়েন্টের অভি ফার্মেসিতে ১৭ ফেরুয়ারি প্রবাসীর স্ত্রী শাহনাজ পারভিন জোৎস্নাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এরপর তার লাশকে ৬ টুকরো করে ঘাতকরা।১৮ ফেব্রুয়ারি গোলাপগঞ্জে মুখে বিষ ঢেলে গৃহবধূ রোমানা আক্তার রিনিকে (৩০) হত্যা করা হয়।

৬ মার্চ সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার তেঘরিয়ায় কলহের জের ধরে স্বামী আব্দুল হামিদ মিল্টন তার স্ত্রী রিপা বেগমকে (৩০) খুন করেন। ১৫ মার্চ দোয়ারাবাজারের আমবাড়ি গ্রামে পানের ভাগবাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে স্বামী আসকর আলীর লাথির আঘাতে ২য় স্ত্রী রিনা বেগম (৩৫) নিহত হন।শায়েস্তাগঞ্জের পূর্ব বাগুনীপাড়ায় ২১ মার্চ ঘুমন্ত অবস্থায় রিনা বেগম (৩৫) নামের গৃহবধূকে হত্যা করা হয়।

জগন্নাথপুরের পাটকুরা এলাকায় ১৬ এপ্রিল স্কুল শিক্ষক স্বামী মৃদুল চন্দ্র সরকারের নির্যাতনে স্ত্রী ছন্দা রানী সরকার খুন হন।কোম্পানীগঞ্জের চাতলপাড় গ্রামের ইদ্রিস আলী ২৭ এপ্রিল তার স্ত্রী হামিদা বেগমকে (৪০) হত্যা করেন।জামালগঞ্জের চানবাড়ি গ্রামে দেবরের দায়ের কোপে ১৩ মে সুলেখা বেগম নিহত হন। শহরতলীর মইয়ারচরে স্বামীর বাড়িতে ৩০ এপ্রিল গৃহবধূ নাজমিন আক্তার খুন হন। গোলাপগঞ্জের এখলাছপুরে ২৫ জুন ইটের আঘাতে বৃদ্ধা হাওয়ারুন বেগম (৬৫) নিহত হন।

গোয়াইনঘাটে ১৫ জুলাই পুত্রকে বাঁচাতে গিয়ে মা হাসিনা বেগম (৫৫) খুন হন। মাধবপুরে ১৮ জুলাই ৪ সন্তানের জননী নেভি আক্তারকে (৪০) স্বামী বখতিয়ার খান খুন করে। শান্তিগঞ্জের ঘোড়াডুম্বুর গ্রামে গৃহবধূ মাসুমা বেগমকে (২০) স্বামী আকিল হোসেন হত্যা করে। মধ্যনগরে ৩০ জুলাই রুজানি দাজেল (৪৫) নামের গৃহবধূকে তার স্বামী আবেল সাংমা লোহার পাইপ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।

চুনারুঘাটের সাতছড়ির গাঢ়টিলায় ৫ আগস্ট পুত্র দ্রুবেশ চাংমা তার গর্ভধারিণী মা সঞ্জিলা সাংমাকে (৬৫) কাটের চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। নগরের বালুচরে তালাবদ্ধ ঘর থেকে ২৪ আগস্ট আফিয়া বেগমের (৩০) বীভৎস লাশ উদ্ধার করা হয়। রাজনগরে ৯ সেপ্টেম্বর গৃহবধূ মিনা বেগমকে হত্যা করা হয়।

চুনারুঘাটে ১৬ সেপ্টেম্বর গৃহবধূ পলি আক্তারকে (৩০) জবাই করে নিজ বসতঘরে হত্যা করে ঘাতকরা। জগন্নাথপুরে ১৮ সেপ্টেম্বর স্বামী নুর আহমদ স্ত্রী আছিয়া বেগমকে (৫০) হত্যা করে। কানাইঘাটে ৯ নভেম্বর এক সন্তানের জননী রাশিদা বেগমমের (২২) গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়।

নবীগঞ্জের চরগাওয়ে নিজের বসতঘর থেকে ১৮ নভেম্বর গৃহবধূ তহুরা বেগমের (৫৫) গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। ছাতকের জাউয়াবাজার এলাকার কামারখালে আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে গৃহবধূ আলেকা বেগমকে (৪০) হত্যা করা হয়। জাফলংয়ে ১২ ডিসেম্বর উদ্ধার করা হয় বিবস্ত্র মহিলার রক্তাক্ত লাশ। দিরাইয়ে বাড়ির সীমানাকে কেন্দ্র করে বৃদ্ধা আয়েশা বেগমকে (৭০) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

জমিজমার বিরোধকে কেন্দ্র করে ৪ জানুয়ারি ফেঞ্চুগঞ্জে নাহিদকে (১৭) খুন করা হয়। সিলেটের শাহপরান এলাকার নিপোবনে ৯ জানুয়ারি শিশু কন্যা সাবিহা আক্তারকে পাষন্ড মা গলাটিপে হত্যা করে। জকিগঞ্জে নিখোঁজের ৫ দিন পরে ৯ সেপ্টেম্বর শাম্মী আক্তারের (৭) বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়।

মাধবপুরে ৪ নভেম্বর ওয়াজ মাহফিল থেকে ফেরার পথে খুন হন আতিকুল ইসলাম মিশু (১৬)। বানিয়াচংয়ের মক্রমপুরে ১৭ সেপ্টেম্বর হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাদ্রাসা ছাত্র আকরাম খানের (৯) লাশ উদ্ধার করা হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। ২০২০ সালে করা বিবিএসের অন্য আরেকটি জরিপ বলছে, পুরুষের তুলনায় নারীদের গড় আয়ু বেড়েছে।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও জেন্ডার বিষয়ক গবেষক আফরোজা সোমা এ বিষয়ে বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়াটা গভীর উদ্বেগজনক। নারীর সংখ্যা ও গড় আয়ু যেমন বেড়েছে, তেমনি হত্যাও বেড়েছে। কম সময়ে সুবিচার নিশ্চিত করা গেলে নারীর প্রতি সহিংসতা কমে আসবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়।এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের নজরদারি প্রয়োজন। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি দ্রুত ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি এডভোকেট রাশিদা সাঈদা খানম বলেন, পারিবারিক কলহের কারণে বেশিরভাগ নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। আছে আর্থিক সংকট, অভাব অনটনের বিষয়েও এক পর্যায়ে নারীকে হত্যা করা হচ্ছে। নেশার টাকার জন্য পুত্রের হাতে মা খুন হচ্ছেন। ব্যাপকভাবে সচেতনতা তৈরি করলে পারিবারিক অপরাধ কমে আসবে।

সিলেট রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশাসন ও অর্থ) নাবিলা জাফরিন রিনা বলেন, সামগ্রিকভাবে সর্বত্র নারী নির্যাতনের ব্যাপকতা বেড়েছে। সিলেটে এক বছরে ২৮ নারী হত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, সামাজিক মূল্যবোধসহ নানা কারণে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। এ বিষয়ে তাদের মনিটরিং অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *