সিলেট বিভাগে এবার কোরবানিযোগ্য পশুর ঘাটতি নেই। বরং উদ্বৃত্ত রয়েছে ৩৬ হাজার ১৪৬টি পশু। বিভাগের ৪ জেলার বিভিন্ন খামারে কোরবানির জন্য প্রস্তুত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ গবাদি পশু। গত কয়েক বছরের মধ্য এবার স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পশু দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন সিলেট বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্টরা।
সিলেট প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে সিলেটে কোরবানির পশু বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অথচ গত বছর ঈদুল আজহায় সিলেট বিভাগে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার ৮১৯টি। চাহিদা ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৯৩টি পশুর। ঘাটতি ছিল প্রায় ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৭৪টি পশুর। এ বছর বিভাগে কোরবানি পশুর চাহিদা ৩ লাখ ৯৪ হাজার ২৫১। এর মধ্যে সিলেট বিভাগে স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত আছে ৪ লাখ ৩০ হাজার ৩৯৭টি। উদ্বৃত্ত আছে ৩৬ হাজার ১৪৬ পশু, যা দেশের অন্য জেলায় সরবরাহ করা যাবে।
সিলেট প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও খামারি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যা, নিত্যপণ্য ও গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় গেল বছর খামারিদের সংখ্যা কমেছে। তাই পশুর উৎপাদনও কমে গিয়েছিল। প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের নানা উদ্যোগ, প্রণোদনা ও স্বাবলম্বীকরণ প্রজেক্টের কারণে এবার বিভাগে খামারির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বেড়েছে উৎপাদিত পশুর সংখ্যা। এক বছরে বিভাগে ষাঁড়, বলদ,গাভি ও মহিষের সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১৬০টি এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩৫টি।
সিলেট বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২২ হাজার ৫৭৬টি খামার রয়েছে। এসব খামারে প্রাকৃতিক উপায়ে চলছে পশু মোটাতাজা করার কাজ। প্রতিটি খামারে ছোট, মাঝারি ও বড় সব ধরনের কোরবানির পশু রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট জেলার ৬ হাজার ৮৫৮টি, সুনামগঞ্জে ৩ হাজার ৪৫৮, মৌলভীবাজারে ৫ হাজার ৩৬৯ ও হবিগঞ্জে ৬ হাজার ৫১৯টি খামার রয়েছে।
কোরবানির ঈদে এ বছর সিলেট বিভাগে প্রায় ৩ লাখ ৯৪ হাজার ২৫১টি পশু চাহিদা রয়েছে। তবে কোরবানিযোগ্য ৪ লাখ ৩০ হাজার ৩৯৭টি পশুর মজুত রয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার ১৮০টি ষাঁড়, ৪৯ হাজার ১০৩টি বলদ, ৩৩ হাজার ৩৭৫টি গাভি, ৪ হাজার ৫৩৩টি মহিষ, ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৩টি ছাগল, ৭০ হাজার ৯৫৩টি ভেড়া ও ১১০টি অন্য পশু রয়েছে।
কোরবানিতে এ বছর সিলেট জেলায় ১ লাখ ৫০ হাজার ৭০৯টি পশুর চাহিদা আছে। জেলায় প্রস্তুত আছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৯২১টি পশু। এর মধ্যে ৬১ হাজার ৫৪০টি ষাঁড়, ৩২ হাজার ৪টি বলদ, ৬ হাজার ১৫১টি গাভি, ২ হাজার ৩৯২টি মহিষ, ৫৬ হাজার ৯২টি ছাগল, ২২ হাজার ৭৩৭টি ভেড়া ও অন্য ৫টি পশু রয়েছে। এবার কোরবানির চাহিদা পূরণ করে জেলায় ৩০ হাজার ২১২টি পশু উদ্বৃত্ত থাকবে।
সুনামগঞ্জে এবার কোরবানি হবে ৫৪ হাজার ৩৬২টি পশু। প্রস্তুত আছে ৬২ হাজার ৬৮৮টি পশু। এর মধ্যে ২৩ হাজার ৪৫৩টি ষাঁড়, ৭ হাজার ৫৮৪টি বলদ, ৭ হাজার ১২৫টি গাভি, ৪৯২টি মহিষ, ১৩ হাজার ১৫৭টি ছাগল, ১০ হাজার ৮২৬টি ভেড়া ও ৫১টি অন্য পশু রয়েছে। জেলাটি এবার চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত থাকবে ৮ হাজার ৩২৬টি পশু।
মৌলভীবাজারে এ বছর কোরবানি হবে ৯৮ হাজার ৫৪২টি পশু। এর মধ্যে জেলায় প্রস্তুত আছে ৮৩ হাজার ৮১২টি পশু। এরমধ্যে ২৩ হাজার ২৯৩টি ষাঁড়, ৪ হাজার ২৫১টি বলদ, ৭ হাজার ৫৭টি গাভি, ৯৯৮টি মহিষ, ৩২ হাজার ২৮৬টি ছাগল, ১৫ হাজার ৮৭৫টি ভেড়া ও ৫২টি অন্য কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে। বিভাগের একমাত্র এই জেলাটিতে ১৪ হাজার ৭৩০টি কোরবানিযোগ্য পশুর ঘাটতি রয়েছে।
হবিগঞ্জে এবার কোরবানি হবে ৯০ হাজার ৬৩৮টি পশু। এর মধ্যে জেলায় প্রস্তুত আছে ১ লাখ ২ হাজার ৯৭৬টি পশু। এর মধ্যে ২৯ হাজার ৮৯৪টি ষাঁড়, ৫ হাজার ২৬৪টি বলদ, ১৩ হাজার ৪২টি গাভি, ৬৫১টি মহিষ, ৩২ হাজার ৬০৮টি ছাগল, ২১ হাজার ৫১৫টি ভেড়া ও ২টি অন্য পশু রয়েছে। জেলাটিতে কোরবানির চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত থাকবে ১২ হাজার ৩৩৮টি পশু।
এদিকে এক বছরের ব্যবধানে সিলেট বিভাগে খামারি বেড়েছে ১০ হাজারের বেশি। গত বছর বিভাগে খামারি ছিল ১২ হাজার ২১১ জন। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৫৭৬ জনে। এ বছর বিভাগে খামারি বেড়েছে ১০ হাজার ২৬৫ জন। ফলে এবার বেড়েছে পশুর সংখ্যা। ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে এখন কোরবানির পশু প্রস্তুতে ব্যস্ত সময় পার করছেন সিলেট বিভাগের খামারিরা। সব খামারে চলছে কোরবানির পশু হৃষ্টপুষ্টকরণ কাজ। প্রতিটি খামারে ছোট, মাঝারি ও বড় সব ধরনের কোরবানির পশু রয়েছে। তবে খামারিরা বলছেন গো-খাদ্য, ওষুধসহ বিদ্যুতের বাড়তি দামের কারণে খামারিদের খরচ বেড়েছে। তাই গত বছরের তুলনায় প্রতিটি গরু লালন-পালনে খরচ বেড়েছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে গরু এলে লোকসানের মুখে পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয় খামারিরা।
সিলেটের রুমান ডেইরি অ্যান্ড ফিশারির পরিচালক মো. আবদুল মতিন রুমান বলেন, পশুখাদ্য সয়াবিন খৈল, গমের ভুসি, রাইস পলিশ, মসুর ভুসি, সরিষার খৈল, ভুট্টা, মুগ ভুসি ও মটর ভুসি। এসবের দাম এবার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তাই গত বছরের তুলনায় প্রতিটি গরু লালন-পালনে খরচ বেড়েছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া তীব্র গরমের কারণে পশুর জন্য বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। আইপিএস দিয়ে ফ্যান চালাতে হচ্ছে। দিনে কয়েকবার গোসল করাতে হচ্ছে। পশুকে ২৪ ঘণ্টা বাতাসের মধ্যে রাখতে হয়। খাবারের সঙ্গে সোডা দিতে হয়। প্রতিনিয়ত শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করতে হয়। তাই শ্রমিকের মজুরি বেশি দিতে হচ্ছে। তাই এবার গরুর দামে কিছুটা প্রভাব পড়বে। তবে সেটা বেশি হবে না। কিন্তু যদি বর্ডার খুলে দেওয়া হয় তাহলে স্থানীয় খামারিদের ওপর এর প্রভাব পড়বে।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অফিসের পরিচালক ডা. মারুফ হাসান জানান, সিলেটে আগে ঘরোয়াভাবে কোরবানিযোগ্য পশু পালন হতো। সেটা এখন কমে গেছে। তাই খামারিদের পশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এবার সিলেট বিভাগে কোরবানিযোগ্য পশুর কোনো ঘাটতি নেই। বরং উদ্বৃত্ত আছে ৩৬ হাজার ১৪৬টি পশু। তাই এবার পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পশু আসার কোনো দরকার নেই। গোখাদ্য ও সব জিনিস পত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারিদের ব্যয় বেড়েছে।
তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরের ন্যায় এবার সিলেট বিভাগে পশুর উৎপাদন বেড়েছে। বিশেষ করে প্রাণিসম্পদ বিভাগের উদ্যোগে বিভাগে ছাগল ও ভেড়ার উৎপাদন বাড়াতে প্রণোদনাসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যার ফলে ১ বছরের ব্যবধানে ছাগল-ভেড়া উৎপাদন বেড়েছে দেড় লাখের বেশি। খামারিকে গবাদি পশু হৃষ্টপুষ্টকরণের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্টেরয়েডের ব্যবহার রোধে উপজেলা পর্যায়ে উঠান-বৈঠক করে খামারিদের হাতে-কলমে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সিলেটের অনেক প্রবাসীর বড় গরু কোরবানি দেওয়ার আগ্রহ বেশি থাকে। আর এই ধরনের বড় গরু সিলেটে স্থানীয়ভাবে খুব কম উৎপাদন হয়। তাই কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বড় পশু সিলেটে আসে। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। তবে স্থানীয়ভাবেই লালন পালন করা পশু বেশি কোরবানি হবে।
শেয়ার করুন