মোঃলুৎফুর রহমান ঃ
সম্প্রতি সিলেটে ঘটে গেল স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা।বৃষ্টি আর ভারত হতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্বক আকারে ধারণ করেছিল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বন্যার পানিতে ডুবে গেল সিলেট নগরীর পথঘাট-লোকালয়। কোথাও পানি ছুঁয়েছে কোমর পর্যন্ত।নগরীর ৮০ শতাংশ বাসায় পানি উঠে ছিল।এটি ছিল চলতি মৌসুমের তৃতীয় দফা বন্যা। একের পর এক বন্যায় বিপর্যস্ত এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। দুই জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি ছিল।বিশেষ করে মেঘালয়ের পাদদেশে অবস্থিত সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা ল ছিল চরম মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। কোথাও কোথাও বিপদ সীমার ৩০০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহ হচ্ছিল।মাত্র এক দিনের পানি বৃদ্ধিতে তলিয়ে গেল গ্রামের পর গ্রাম।হাওর, বাওর,মাঠ, ঘাট, ভিটে বাড়ি, ঘরের চাল, হালের বলদ, গোলার ধান, গৃহস্থলির জিনিসপত্র, আসভাব পত্র, বই পত্র,কাপড় চোপড়, সব কিছু ভেসে একাকার হয়ে গেল।এ যেন এক নীরব তান্ডব, কিয়ামতের ভয়াবহতার পূর্বাভাস।
গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার এবং সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ পানিবন্ধী ছিল।সবার ঘরে পানি। প্রতিটি ঘরে গড়ে ৩-৬ ফুট পর্যন্ত পানি ছিল।এমন ভয়াবহ দুর্যোগ, বিপর্যস্থ জনজীবন ইতিপূর্বে কেউ দেখেনি।হাওরের মধ্যে এক সাথে গলাগলি করে ভেসে যায়, মা ছেলের লাশ,বাবা মেয়ের লাশ, গৃহ পালিত পশু মালিকের লাশ।এ যেন এক বাচার আকুতি,আর্তনাদ, অহেতুক প্রচেষ্টা সব কিছু নিঃশেষ করে মানুষকে নিয়ে যায় মৃত্যু পল্লীর দিকে।
নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে উঁচু স্থান, স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্রে হন্য হয়ে ছুটে বানভাসি মানুষ। পরণে শুকনো কাপড় নেই,ঘরে খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানির সংকট সব মিলিয়ে দেখা দেয় শতাব্দীর সব চেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়। কেউ ঘরে ছোট নৌকার উপর,বাশ দিয়ে মাচা বেধে,কেউ চালের উপর,কেউ গাছের উপর, আবার কেউ ঘরের তীরে লটকিয়ে থেকেছেন ৩/৪ দিন। অবিরাম বৃষ্টি,মাঝারি ধরনের ধমকা হাওয়া, ঘন ঘন বজ্রপাত, পানিতে জলোচ্ছাসের মত বড় বড় ঢেউ সব মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর আতংক মানুষকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। খাদ্যের অভাবে আশ্রয় কেন্দ্রে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাতে হয়েছে বানভাসি মানুষের।২০০ মানুষের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ভীড় জমায় ২-৩ হাজার মানুষ। একটু বাচার জন্য হন্য হয়ে ঘুরা মায়ের কূল থেকে টুপ করে পড়ে যায় মায়ের স্নেহের অবুঝ শিশুটি। স্রোতের প্রবল ঝাপটায় কোথায় নিয়ে যায়,আর খোজ মিলেনি।
এ পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হলেও কত মৃত লাশ যে পড়ে আছে হাওরে,বাওরে কিংবা নদীর কিনারে তা বেখবর। অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর প্রাথমিক হিসাবমতে ২১শে মে প্রথম দফা বন্যায় ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর আউশ ধানের বীজতলা, বোরো ধান ১ হাজার ৭০৪ হেক্টর ও ১ হাজার ৫৩৮ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নগরীসহ সিলেট সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় ৫৩৬ কিলোমিটার সড়ক। জেলার ১১ উপজেলার ৭ হাজার ২৫১টি পুকুর ডুবে গিয়েছে। সব মিলিয়ে বন্যায় ১ হাজার ৩৩৭ টন মাছ ও ১২১ টন পোনা বেরিয়ে গিয়েছে।
এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।এদিকে এপ্রিল থেকে দুই দফা বন্যায় সিলেটের চার জেলায় কৃষিতে অন্তত ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে বেসরকারি সূত্রে জানা গেছে। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত ১২০ কোটি টাকার ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। বন্যায় সিলেট অঞ্চলের ৯১ হাজার কৃষক বোরো জমি, আউশ, বাদাম ও সবজি ক্ষেত হারিয়ে নিঃস্ব। এপ্রিলে প্রথম দফা বন্যায় কেবল সুনামগঞ্জ ও সিলেটে ৬ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমির ফসল ডুবে যায়। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
এমন ভয়াবহ বন্যার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ভারতের প্রবল বৃষ্টিপাতকে প্রথমত দায়ী করা হচ্ছে।বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকার একটি হল চেরাপুঞ্জিসহ ভারতের আসাম মেঘালয়।মাত্র তিন দিনে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে, যা গত ২৭ বছরের মধ্যে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। আবহাওয়া অফিস এর তথ্য মতে সিলেট সংলগ্ন মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৯৭২ মিলিমিটার। একই রাজ্যের শিলংয়ে ১০১, আসামের গৌহাটিতে ৪২ আর ধুব্রিতে ৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে বৃহস্পতিবার বৃষ্টি হয়েছে ৬৭৪ মিলিমিটার। জুন মাসের শুক্রবার পর্যন্ত চেরাপুঞ্জিতে ৪০৮১ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে বুধবার সাড়ে ৮টার আগের ২৪ ঘণ্টায় ৮১১.৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। চেরাপুঞ্জিতে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়ে ছিল ১৯৯৫ সালের ১৬ জুন। সেদিন ওই এলাকায় ১৫৬৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয় ১৯৫৬ সালের ৫ জুন। সেদিন বৃষ্টিপাত হয় ৯৭৩ দশমিক ৮ মিলিমিটার।কিন্তু ২০২২ সালের জুনের বৃষ্টি পাত সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে যা ১২২ বছরের ইতিহাসে এক সাথে এত বৃষ্টিপাত হয় নি।প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট ভারতীয় ঢল ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলকে ডুবিয়ে দিয়েছে – এ কথা সবারই জানা।কেননা সিলেট অঞ্চলের গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের কিছু অঞ্চল হল মেঘালয়ের পাহাড়ি প্রবাহের ডাস্টবিন।
সুতরাং ভারতের পাহাড় থেকে বাংলাদেশের উপর পানি পড়বেই।তবে সেই ঢলের পানি কেন সিলেট থেকে দ্রুত সরে দক্ষিণে নেমে যাচ্ছে না? পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্ত কেন হচ্ছে? সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার ভয়াবহতা দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করেছে কোন কারণে? এমন প্রশ্ন ছিল জনমনে।
এ বিষয়ে পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মত, চার কারণে এবার ভয়াবহ বন্যায় নাকাল অবস্থা সিলেটের। সেগুলো হলো – নদীর নাব্যতা সংকট, হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ ও সুইচগেট নির্মাণ, হাওর বিল ঝিল ভরাট, নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কাটা।কিন্তু তার অন্যেতম কারণ হলো পিয়াইন নদী ভরাট হয়ে যাওয়া। প্রমত্তা পদ্মার মতো এক সময় পিয়াইন নদীর যৌবন কাল ছিল।খরস্রোতা পিয়াইন নদী এক সময় ছিল বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বানিজ্যিক যাতায়াতের অন্যেতম পথ। ব্রিটিশ শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজত্বকালে পিয়াইন নদীর গভীরতা ছিল ৩০-৪০ মিটার। খরস্রোতা পিয়াইন নদী দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর জাহাজ ও স্টীমার চেরাপুঞ্জি পর্যন্ত চলাচল করত। পিয়াইন নদী দিয়েই কোম্পানী তখন চুনাপাথর সংগ্রহ করত।
পিয়াইন নদীর তীরে বৃটিশদের ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ ভীড় করত,বিভিন্ন সময় নোঙ্গর করত।পরবর্তীতে এটা ছোট্র গঞ্জে পরিণত হয় যা আজকের কোম্পানিগঞ্জ হিসেবে খ্যাত।গতি, স্রোত এবং প্রবাহ হারানো পিয়াইন ভরাট হতে হতে আজ বিলুপ্তির পথে।অথচ স্রোতস্বিনী এই পিয়াইন নদী বা পিয়াইন গাং Piyain River) বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটির বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ৫১ কিলোমিটার এবং মোট দৈর্ঘ্য ১৪৫ কিলোমিটার, প্রস্থ ১১৫ মিটার, প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটি বাংলাদেশের সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ ও ছাতক উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহমান। পিয়াইন নদী ভারতের আসামের ওম বা উমগট নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে সিলেট জেলাধীন গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার দক্ষিণ ইসলামপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে সুরমা নদীতে পতিত হয়েছে। যার উৎপত্তি হয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ওমগট নদী থেকে। বাংলাদেশে প্রবেশের পথেই ওমগট নদী দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। যার একটি পিয়াইন নাম ধারণ করে সীমান্তঘেঁষে পাদুয়া হয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের উত্তর দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে ছাতকের কাছে সুরমা নদীতে মিলিত হয়েছে। অন্য শাখাটি ডাউকি নামধারণ করে পর্যটন কেন্দ্র জাফলং ও বল্লাঘাট পাথর কোয়ারি এলাকা হয়ে পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের মুখতোলা নামক স্থানে সারী-গোয়াইন নদীর সঙ্গে মিশেছে।এক কালের খরস্রোতা পিয়াইন মুল নদীটি জাফলং থেকে নকশিয়া পুঞ্জি, খাসিয়া পুঞ্জির পাশ দিয়ে পান্তুমাই হয়ে, মনাইকান্দি, গোরা গ্রাম, হাদার পার, লামাবাজার হয়ে, কুনকিরির পাশ দিয়ে, রুস্তমপুর গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে, লামনী, খালর পাড় হয়ে গোজারকান্দিতে পাতনী খালের সাথে মিলিত হয়ে মনু গাং নামে নতুন নাম ধারণ করে।অপর দিকে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার মনোর পাড় হয়ে চামারা কান্দি, ফেদারবাড়ি হয়ে ভোলাগঞ্জ হতে আসা ধলাই নদীর সাথে তেলিখাল নামক স্থানে কাটাগাং অতিক্রম করে চেঙ্গের খালের সাথে মিলিত হয়ে চাতক উপজেলায় সুরমায় পতিত হয়। সুরমায় পতিত হওয়া প্রবহমান জল রাশি কালনি, মেঘনা হয়ে বঙ্গপোসাগরে পতিত হত।স্রোতস্বিনী ঐতিহ্যের পিয়াইন নদী আজ হারিয়েছে নাব্যতা, হারিয়েছে গতিপথ। পিয়াইনের বুকে ধু-ধু বালুচর। শুকনা মৌসুমে নদীটি পুরোপুরি শুকিয়ে যায়।নদীর বুকে রবি শষ্য ফলানো হয়।মুল নদীটি পান্তুমাই হয়ে চাতক চলে গেলেও ছাতক পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার পথে এর ২২টি বাঁক রয়েছে । অপর দিকে জাফলং থেকে বয়ে চলা মুল পিয়াইন নদীটি পান্তুমাই -গোরাগ্রাম -হাদারপার-লামনী থেকে খালপার পর্যন্ত মৃত প্রায়। এক সময় নদীর প্রশস্থতা থাকলেও এখন নদীর দু তীরে গড়ে উঠেছে জনবসতি। নদীটি এমনভাবে ছোট হয়ে এসেছে কাছে গিয়ে দাড়ালে মনে হয় ছোট্র একটা খাল।রুস্তমপুর ইউনিয়ন পরিষদ কমমপ্লেক্স এর সামন থেকে নদীর দু ধারে যথাক্রমে কুনকিরি, রুস্তমপুর, লামনী গ্রাম রয়েছে। এত বড় নদী বর্তমানে এমন অবস্থায় পরিণত হয়েছে, বর্ষা মৌসুমে নদীতে ৫০-৬০ ফুট বাশের সাকু দিয়ে অনায়াসে পারা পার করা যায়।নদীর তল দেশ ভরাট হতে হতে এমন হয়েছে শুকনো মওসুমে প্রায় ৮০ কিলোমিটার জায়গায় শুকিয়ে যায়, যেখানে শস্য, ফসল চাষাবাদ হয়।ডাউকি থেকে নেমে আসা ভারতের পাহাড়ি ঢল পিয়াইন নদীর মুখে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কিছুটা চলে যায় গোয়াইন নদী হয়ে চেঙ্গের খাল, কিছু ঢল সারি নদী হয়ে সুরমায়, আবার অল্প কিছু ঢ্ল পিয়াইন হয়ে সুরমায়।নদীর অগভীর তলদেশ হয়ে যাওয়ার কারণে, অনেক জায়গায় মাঝ নদীর বুকে ঘর বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পিয়াইন নদী এখন বিলুপ্তির পথে।
এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে ভারতের পাহাড়ি ঢল বাংলাদেশে পতিত হয়ে সঠিক গতিপথ না থাকায় সমতলভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে।মুহুর্তের মধ্যেই তলীয়ে যায় সব কিছু। প্রথমে ক্ষেতের ফসল,রাস্তা ঘাট, অবশেষে বসত ভিটা।সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ সুনামগঞ্জবাসী ভারতীয় ঢলের ভয়াবহতার সম্মুখীন হয়েছে ১৯৮৮, ১৯৯৮ এবং ২০০৪ সালে।কিন্তু ২০২২ সালের ভয়াবহতা, ধবংস লীলা ছিল অবর্ননীয়। ১৯৮৮ এবং ২০০৪ সালের বন্যার চেয়ে ২০২২ সালের বন্যা আরো ৩ ফুট বেশী পানি ছিল।পানির প্রবাহ ছিল বিপদ সীমার ২৫০-৩০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত।অন্য দিকে গোয়াইনঘাট -কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার পানি প্রবাহের অন্যেতম আরেকটা বাধা হল, সালুটিকর -ভোলাগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক।এবারের বন্যায় পাহাড়ি ঢলের পানি সব চেয়ে বেশী বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে এই সড়কে।পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্রিজ এবং কালভার্ট না থাকার কারণে সড়কে বাধা পেয়ে পানি ফুলে উঠতেছে এবং ঘরবাড়ি তলিয়ে ৪-৫ ফুট উপরে পানি উঠেছে।
সারি নদ বাঁচাও আন্দোলন কমিটির সভাপতি আবদুল হাই আল হাদি বলেন, ‘মেঘালয়ে বৃষ্টিপাতের কারণে যে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়, এর সবই চলে আসে সিলেটে। সেই ঢলে আসা পাহাড়ি বালু-মাটি-পলি জমতে জমতে নদ-নদীগুলো প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। এতে নদীগুলো ক্রমে সংকোচন ও ভরাট হয়েছে। পাশাপাশি যত্রতত্র সুইচগেট ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণেও নদীর প্রবাহপথ আরও বেশি সংকুচিত হয়েছে। যে কারণে এবারের বন্যার এতো ভয়াবহতা। এ রকম পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে হলে সিলেটের নদ-নদীগুলোর নাব্যতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। নদী দখলমুক্ত করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড় ও জলাধার খনন করতে হবে। গোয়াইনঘাটে পিয়াইন নদী খনন করতে হবে “।
এ সমস্যার স্হায়ী সমাধানের জন্য ঐতিহাসিক “পিয়াইন নদী খনন প্রকল্প ” বাস্তবায়ন একান্ত জরুরী ও জনগুরুত্বপূর্ণ।১৯৫৪ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদে মরহুম মকবুল হোসেন এম.পি ও পিয়াইন নদীর সমস্যাটি সমাধানের জন্য সর্ব প্রথম সরকারের নিকট প্রস্তাব পেশ করেন।কিন্তু ১৯৫৬ সালে তার অকাল মৃত্যুতে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এম. তৈয়বুর রহমান ছাত্রাবস্থায় প্রথম ১৯৭৫ সালে তৎকালীন নৌ পরিবহনমন্ত্রী মরহুম আব্দুর রব সেরনিয়াবাত মহোদয়ের নিকট পিয়াইন নদী খননের জন্য দরখাস্ত প্রদান করেন।পরবর্তীতে তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে বেশ কয়েক বার আবেদন করেন।উনার আবেদন প্রেক্ষিতে জাইকার মাধ্যমে একটি সমীক্ষা হয়।কিন্তু সেই সমীক্ষা কাগজ কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৮৫ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কোম্পানীগঞ্জ সফরে এলে মরহুম এম তৈয়বুর রহমান মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পিয়াইন নদী খননের দাবী উত্তাপন করেন।কোম্পানীগঞ্জ থানা সদরের বিরাট জনসভায় রাষ্ট্রপতি এ সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি দান করেন।পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের ২৩ শে জুলাই সিলেট পানি উন্নয়ন সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কর্তৃক দুই পর্যায়ে ৪০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রধান প্রকৌশলী উত্তর পূর্বাঞ্চলের নিকট প্রেরণ করা হয়। প্রস্তাবনায় প্রকল্পের ব্যাপক সমীক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ সত্ত্বেও পরবর্তী ৪ বছর যাবৎ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হতে মাঠ পর্যায়ে সমীক্ষা গ্রহণের জন্য বা প্রকল্প প্রণয়নের জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশের চতুর্থ জাতীয় সংসদে তৎকালীন সেচ, পানি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী পিয়াইন নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মন্ত্রীর বিবৃতির সত্যতা প্রমাণিত হয়নি।১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড পিয়াইন নদী বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের জন্য প্রায় ৪৮.৩ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে একটি প্রকল্প সার পত্র (চ.ঝ.চ) তৈরী করা হয়। কিন্তু প্রকল্পটির ব্যাপারে আর কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। কোম্পানিগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম এম তৈয়বুর রহমান আমৃত্যু সরকারের বিভিন্ন দফতরে পিয়াইন নদী খনন প্রকল্প বাস্তবায়নের আকুতি জানিয়ে গেছেন।২০১৩ সালের ১০ই মার্চ আকষ্মিকভাবে তিনি মৃত্যু বরণ করলে পিয়াইন নদী খনন আন্দোলন থেমে যায়। দীর্ঘ ৫০ বছর পর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করেছি, মুজিব শত বর্ষ উদযাপন করেছি।মুজিব শত বর্ষ উপলক্ষে সরকার দেশের অগভীর বেশ কিছু নদী খনন প্রকল্প হাতে নিলেও পিয়াইন প্রকল্প ভেস্তে যায়।
অত্র অঞ্চলের ৮ লাখেরও অধিক মানুষের জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। বার বার প্রলয়ঙ্কারী বন্যার ছোবল জনজীবনের অভিশাপ হয়েই বিরাজ করছে। এ অভিশাপের কবল থেকে কখন যে জনগণ মুক্তি পাবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। সরকারের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে আর কতকাল পিয়াইন নদী দুঃসহ যন্ত্রণা ও বঞ্চনার কারণ হয়ে থাকবে তা সরকারই ভাল জানেন। ৮ লক্ষাধিক জনতার জীবন যাত্রার নিশ্চয়তা প্রদানের স্বার্থে, তাদের জীবন ধারণের মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার শীঘ্রই পিয়াইন নদী বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবেন এই সঙ্গত দাবী জনসাধারণের পক্ষ থেকে।
সিলেট -৪ তথা গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানিগঞ্জ নির্বাচনী এলাকার সাংসদ, মাননীয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ, পানি সম্পদ মন্ত্রী মহোদয় এর সুদৃষ্টিই পারে এই ৮ লক্ষ পানি বন্ধী মানুষের চিরদিনের দুঃখ ঘুচিয়ে আলোকিত পৃথিবীতে স্বাচ্ছন্দ্যে বাচার সুযোগ করে দিতে। পিয়াইন নদী খনন করে উভয় তীরে গার্ড ওয়াল দিয়ে শক্তিশালী বাধ নির্মাণ করলে, পাহাড়ি ঢল নদী পথে চলে যাবে আপন ঠিকানায়।সমতল ভুমিতে পতিত হয়ে ভয়ংকর বন্যার সৃষ্টি হবে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ও আর কিছু না হলেও মানুষ দু মুটো ভাত খেয়ে স্বাধীনভাবে বাচতে যদি না পারে, তাহলে এই স্বাধীনতা এই জীবনের কোন স্বার্থকতা নেই।
প্রভাষক, ইংরেজি
রুস্তমপুর কলেজ,গোয়াইনঘাট ,সিলেট