সিলেটে যে কৌশল অবলম্বন করে মোটরসাইকেল চোর চক্র

সিলেট

সিলেট বিভাগজুড়ে সম্প্রতি বেড়েছে মোটরসাইকেল চোর চক্রের অপতৎরতা। নানা কৌশলে বেড়েছে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে- চোরেরা এত ট্রেইনড যে, এক মিনিটেই যে কোনো মোরসাইকেল আনলক করতে পারে। 

তবে এসব ঘটনায় কেউ দ্বারস্থ হন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, কেউ হন না। আবার অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারস্থ হয়েও ফিরে পান না নিজের মোটরসাইকেল। ফলে দিন দিন হতাশা ও আতঙ্ক বাড়ছে সিলেটের মোটরসাইকেল মালিক বা চালকদের মাঝে।

পুলিশ বলছে- সিলেট থেকে মোটরসাইকেল চুরি করে অল্প সময়ের মধ্যেই সিলেটের বাইরে নিয়ে যায় চোর চক্র। ফলে অনেক সময় চুরি যাওয়া  মোটরসাইকেলটি ধরতে একটু সময় লাগে। তবে চুরির ঘটনায় পুলিশের আশ্রয় নিলে ভুক্তিভোগিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে পুলিশ।

জানা গেছে, সর্বশেষ গত ৭ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার চন্ডিপুলস্থ নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেইটের সামনে থেকে সদর উপজেলার পিরেরচক গ্রামের সরফ মিয়ার ছেলে শাহিন আহমদের (৩৫) মোটরসাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। ওই দিন তিনি নর্থ ইস্ট হাসপাতালে অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে যান। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেইটের সামনে তার হিরো কোম্পানির মোটরসাইকেলটি রেখে ভিতরে গেলে পরবর্তীতে রাত সাড়ে ১০টার দিকে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আর মোটরসাইকেলটি পাননি।

পরে হাসপাতাল গেটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শাহিন নিশ্চিত হন- তাঁর মোটরসাইকেলটি চোর নিয়ে গেছে। এ ঘটনায় পরে দক্ষিণ সুরমা থানায় তিনি সাধারণ ডায়েরি করেন। তবে এখনও তার মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করা হয়নি।

জানা গেছে- বিভাগের মধ্যে মৌলভীবাজারে সম্প্রতি বেশ বেড়েছে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা। জেলার কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ উপজেলায় সংঘবদ্ধ মোটরসাইকেল চোর চক্রের অপতৎপরতা বেড়েছে। নভেম্বর মাসের শেষ ১৫ দিনে এই ২ উপজেলা থেকে ১৫টি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। ভুক্তভোগির তালিকায় বিমানবাহিনী ও পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি সাংবাদিকরাও আছেন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, চোর চক্রের সসদ্যদের ধরতে পুলিশ যথেষ্ট তৎপর না। অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় থানায় কয়েকটি সাধারণ ডায়রি করা হলেও মামলা দায়ের করা হচ্ছে না। মামলা না হলে সুরাহা পাওয়াটা কঠিন।

এই ১৫ দিনের মধ্যে কুলাউড়ার স্থানীয় সাংবাদিক সঞ্জয় দেবনাথের ১টি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গ্রাম উন্নয়ন কার্যক্রম নামক সংস্থার গ্যারেজ থেকে দুটি ও কুড়াউড়ার মাগুরা এলাকার আরেক বাসিন্দা পাভেল বক্সের ১টি মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটেছে।

অপরদিকে, একই সময়ে কমলগঞ্জের শমশেরনগর বাজারের একটি বাসা থেকে বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল ইসলামের একটি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। তাঁর পাশের আরেকটি বাসা থেকেও ওই সময় মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটে। এছাড়া কুলাউড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহ আলমের বাড়ি কমলগঞ্জের শমশেরনগর এলাকায়। এক শুক্রবার তিনি বাড়ির গ্যারেজে মোটরসাইকেল রেখে জুম্মার নামাজে যান। পরে নামাজ থেকে ফিরে দেখেন- মোটরসাইকেলটি চুরি হয়ে গেছে।

কমলগঞ্জ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি নুরুল মুহায়মিন মিল্টনের দাবি- কমলগঞ্জ উপজেলায় ওই ১৫ দিনে অন্তত ৯টি মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু পুলিশের উপর আস্থা না থাকায় ভুক্তভোগীদের অনেকে থানায় ডায়রি পর্যন্ত করেননি।

অপরদিকে, গত ১৩ নভেম্বর বিকেলে হবিগঞ্জে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভেতর থেকে ওই জেলার প্রেসক্লাবের সভাপতি রাসেল চৌধুরীর মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটে

ভুক্তভোগিদের বক্তব্য- মোটরসাইকেল ‍চুরির সঙ্গে জড়িত সংঘবদ্ধ চোর চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে না পারলে চুরি থামবে না। জিডির পর চুরির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ। এরপর আর খোঁজ থাকে না। পরে নিজ উদ্যোগে নিজের চুরি যাওয়া মোটরসাইকেলের সন্ধান করতে করতে এক সময় থেমে যেতে হয়।

তবে সম্প্রতি মৌলভীবাজার থেকে মোটরসাইকেল চোর চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এসময় তাদের কাছ থেকে ৫টি চোরাই মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে।

গত ৯ ডিসেম্বর (শুক্রবার) দুপুরে কুলাউড়া থানাপুলিশ আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কুলাউড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দীপংকর ঘোষ জানান- সাম্প্রতিক সময়ে কুলাউড়া ও অন্যান্য উপজেলা থেকে বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার পর সাড়াঁশি অভিযানে  নামে পুলিশ। অভিযানকালে প্রথমে আন্তঃজেলা ও আন্তঃবিভাগীয় মোটরসাইকেল চোর চক্রের সদস্যদের মধ্যে অন্যতম দুর্ধর্ষ মোটরসাইকেল চোর কমলগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা জাহাঙ্গীরকে কুলাউড়া পৌরসভাধীন কাছুরকাপন এলাকা থেকে মোটরসাইকেলের তালা ভাঙার যন্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আন্তঃজেলা ও বিভাগীয় মোটরসাইকেল চোর রাসেলকে কমলগঞ্জ থানার কালেঙ্গা গ্রামের তার শ্বশুরবাড়ি থেকে ১টি মোটরসাইকেলের খোলা বডিসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরে গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া তথ্যমতে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার মেহেরপুর গ্রাম থেকে চোরাই মোটরসাইকেল চোর চক্রের অন্যতম হোতা জুনেদকে গ্রেপ্তার করলে তার কাছ থেকে ১টি চোরাই পালসার মোটরসাইকেল ও মোটরসাইকেল খোলার যন্ত্রাংশ উদ্ধারসহ জব্দ করা হয়।

তিনি আরও জানান, জাহাঙ্গীর, রাসেল ও জুনেদকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেয়া তথ্যমতে আন্তঃবিভাগীয় চোর চক্রের সক্রিয় সদস্য সামাদের নিজ বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার পানিয়াগাঁ গ্রামে অভিযান চালালে পুলিশের উপস্থিতিতে সে সটকে পড়ে। এ সময় তার বাড়ি থেকে ১টি চোরাই সুজুকি মোটরসাইকেল ও ১টি আরটিআর মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া তথ্যমতে আরও ১টি ডিসকোভার মোটরসাইকেলও উদ্ধার করে জব্দ করা হয়।

মোটরসাইকেল চোর চক্রের পলাতক সদস্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

এর আগে ৩০ নভেম্বর কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার সম্ভুপুর রেললাইন সংলগ্ন বস্তি থেকে মোটরসাইকেল চোর চক্রের এক সদস্যকে আটক করে   র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। তার নাম রিপন মিয়া (৩০)। র‍্যাবের দাবি, রিপন এই সংঘবদ্ধ চোর চক্রের মূল হোতা। তার নেটওয়ার্ক সিলেটসহ দেশজুড়ে।

র‍্যাব জানায়, রিপন কৌশলে ১ মিনিটেই যে কোনো মোটরসাইকেল আনলক করতে পারেন। মোটরসাইকেল চুরির অভিজ্ঞতা তার দীর্ঘদিনের। দলবল নিয়ে হবিগঞ্জ থেকে মোটরসাইকেল চুরির পর সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা সহযোগিদের মাধ্যমে বিক্রি করতেন তিনি। থাকতেন আত্মগোপনে।

এছাড়া সিলেটে মোটরসাইকেল চুরি করতে একটি বিশেষ চাবি ব্যবহার করে আসছে আন্তজেলা চোর চক্রের সদস্যরা। সেই চাবিকে সাংকেতিক ভাষায় ‘সিম’ বলে তারা। চলতি বছরের মার্চ মাসে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা কমপ্লেক্স থেকে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার চুরি হওয়া মোটরসাইকেল উদ্ধারের সময় এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য জানতে পারে পুলিশ।

মোটরসাইকের চুরির বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ রোববার (১১ ডিসেম্বর) সিলেটভিউ-কে বলেন- সম্ভবত ঢাকা শহরের চাইতেও সিলেটে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেশি। তাই চোরদের তৎপরতাও সিলেটে বেশি। তবে ঘটনার পর আমাদের দ্বারস্থ হলে ভুক্তভোগিকে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করি।

তিনি বলেন- একটি বিষয় হচ্ছে, চোরেরা সিলেট থেকে মোটরসাইকেল চুরি করে অল্প সময়ের মধ্যেই শহর বা জেলার বাইরে নিয়ে যায় এবং গাড়ির রং, ডিজাইন বা অনেক যন্ত্রাংশ বদলে ফেলে। তাই অনেক সময় মোটরসাইকেল উদ্ধারে একটু সময় লাগে।

তবে নিজের মোরটসাইকেল রক্ষার স্বার্থে মালিকদের একটু কৌশলী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এসএমপি কমিশনার বলেন- এখন তো প্রযুক্তির যোগ। মোটরসাইকেলে গোপন ট্র্যাকার যুক্ত করা যায়। এগুলোর মূল্যও খুব বেশি না। এই সামান্য টাকার ভয়ে অনেক সময় অনেককে দেড়-দুই লাখ টাকার মোটরসাইকেল হারাতে হয়।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *