সারাদেশের মতো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সিলেট জেলার ৬ টি সংসদীয় আসনে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। সংবিধান অনুযায়ী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এখনোও বছর খানেক সময় বাকী আছে। জাতীয় নির্বাচন কে নিয়ে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মত বড় দুটি দলের মধ্যে তেমন কোন সাংগঠনিক তৎপরতা না থাকলেও জামায়াত আছে সোস্যাল মিডিয়ার ব্যাপক প্রচারণায়।দলগুলোর জেলা পর্যায়ের নেতাদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, আওয়ামীলীগ জেলা পরিষদ নির্বাচন, বিএনপি গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও জামায়াত দলের অফিসিয়াল ডিক্লারেশন ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব রয়েছে।
আগামী সংসদ নির্বাচন দেশের রাজনীতিতে বিশাল প্রভাব পড়বে। অনেক নতুন নতুন দল জন্মলাভ করেছে। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল, প্রতীক নেই, বিএনপি জোট থেকে সরে দাঁড়ানো সব মিলিয়ে ভোটের হিসাব নিকাশ কোনদিকে মোড় নিবে তা নিয়ে ভোটারদের মধ্যেই চলছে আলাপ আলোচনা,নানা গুঞ্জন। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতি ও নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ ও মতবিনিময় করেছেন। দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট প্রায় দুই যুগ থেকে দলগত ভাবে নির্বাচন করে আসছে।সাম্প্রতিক কালে বিএনপির জোটে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।বিএনপির বড় অংশীদার জামাত জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে।এবং সারাদেশে বিভিন্ন আসনে নিজেদের প্রার্থীদের কৌশলে কাজ করতে বলেছে।সিলেট জেলার ৬ টি আসনের মধ্যে প্রায় সবকটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে কাজ শুরু করেছে জামায়াত। অপরদিকে বিএনপি সিলেটের প্রত্যেকটি আসনে তাদের হেভীওয়েট প্রার্থীদের গ্রীণ সিগনাল দিয়েছে। বিরোধী জোটের এমন টানাপোড়ন থাকলে আগামী নির্বাচনে সিলেটের সবকটি আসনে আওয়ামী লীগের জয়ের সম্ভাবনা বেশি রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
এ আসনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে বিএনপি ভালো প্রার্থী দিলে এই আসনে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে।এদিক দিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর প্রার্থীতার বিষয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
বিশ্বস্থ সূত্রে খবর পাওয়া গেছে,দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের সাথে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা আরিফুল হক চৌধুরী জোর লবিং করছেন। সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী অথবা বিএনপি ভালো প্রার্থী দিতে পারলে আওয়ামীলীগ হেরে যাবে বলে ভোটাররা মনে করছেন। এ আসনে বরাবর বাহিরের বড় বড় নেতারা এমপি হয়েছেন। জামায়াত এ আসন নিয়ে স্বপ্ন দেখলেও বিএনপি’র সাথে জোট ভঙ্গ হয়ে গেলে আর জোট সমর্থন না দিলে জামায়াত সুবিধা করতে পারবে না।
তাছাড়া ১৯৯৬ এর নির্বাচনে জামায়াত জমিয়তের চেয়ে কম ভোট পেয়েছে। গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থান দুর্বল, বিশাল সংখ্যক কাওমী মাদ্রাসার আলেমদের জামায়াত বিরোধিতা,জামায়াতের সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থীর দলে বড় পদ না থাকা সহ বিএনপি’র উপর ভর করে চলা নীতি পেছনে ফেলে দিবে বলে সচেতন মহল মনে করছেন।অপরদিকে জামায়াত প্রার্থীর মত গোয়াইনঘাট উপজেলার বিএনপি নেতা হাকিম চৌধুরী ও দু’বারের উপজেলা চেয়ারম্যান ও মাটির সন্তান।
সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি হাফিজ আহমদ মজুমদার, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমেদ, সীমান্তিক এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ড.আহমদ আল কবির, আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাক আহমদ পলাশ, বিএনপি থেকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আবুল হারিছ চৌধুরীর ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী, বিএনপি নেতা চাকসু’র সাবেক আ্যপায়ন সম্পাদক মামুনুর রশীদ মামুন, জমিয়ত থেকে মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক,জাতীয় পার্টি থেকে সাবেক এমপি সেলিম উদ্দিনের নাম শোনা যাচ্ছে। এই আসনে জামাত দলটির জেলা আমীর হাফেজ আনোয়ার হোসেন খান কে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে। দলটির প্রভাবশালী জনপ্রিয় নেতা সাবেক এমপি ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী অসুস্থ থাকায় নতুন প্রার্থীকে নিয়ে জনমনে বিশাল প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সচেতন মহল মনে করেন জামাত অধ্যুষিত এ এলাকাটি দুর্বল প্রার্থীর কারণে হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। এ আসনটি জামায়াতের সবে ধন নীলমণি।
সিলেট -৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে বর্তমান এমপি নুরুল ইসলাম নাহিদ, ক্যানাডা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দৈনিক শুভ প্রতিদিন এর সম্পাদক ও প্রকাশক সারওয়ার হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান, বিএনপি নেতা ও দৈনিক সিলেট মিররের প্রকাশক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ফয়সল আহমদ চৌধুরী, বিএনপি’র চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী, জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ইমরান আহমদ চৌধুরীর নাম শোনা যাচ্ছে। অপরদকে জামাতের ঢাকা মহানগর শাখার আমীর মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন কে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামাত। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে।সোস্যাল মিডিয়ায় তুলোধুনো করছেন নেতা কর্মীরা। সেলিম উদ্দিন মৌলভীবাজার জেলায় ছাত্র রাজনীতি করলেও জামাত আমীর শফিকুর রহমান চৌধুরীর বলয়ের লোক হওয়ায় সিলেট শিবিরের সভাপতি হয়েছেন।পরে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থীও হয়েছেন। জামায়াতের পুরনো প্রাচীন ও অনেক পোড় খাওয়া নেতাদের পেছনে ফেলে তিনি হয়েছেন বড় নেতা। দীর্ঘদিন থেকে সিলেটের রাজনীতিতে প্রবেশ করার চিন্তা থেকেই এ প্রার্থীতা ঘোষণা বলে মনে করছেন ছাত্র শিবিরের অনেক প্রাক্তন নেতা। সেলিম উদ্দিন সিলেটে ছাত্র নেতা থাকতে অনেককেই দল থেকে বহিষ্কার করেছেন বলে জানা গেছে। এই আসনে জামাতের প্রার্থী ছিলেন যুদ্ধাপরাধী মামলায় অভিযুক্ত মাওলানা হাবিবুর রহমান। তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে জামাতের দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। বিগত নিবর্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সাথে বিপুলভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন এবং অল্প ভোটে পরাজিত হোন। তৃণমূলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও পরিচিত থাকায় তাঁর বদলে নতুন প্রার্থীকে দলটির কর্মী সমর্থকরা সহজভাবে গ্রহণ করছেননা বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।সাম্প্রতিক কালে মাওলানা হাবিবুর রহমান কে দলের ঘরোয়া মিটিং ছাড়া আর তার তৎপরতা নেই। সিন্ডিকেট ও বলয় রাজনীতিতে মাওলানা হাবিবুর রহমান পরাজিত বলে দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক নেতাকর্মী তা জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে সিলেট আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। যে কোন নির্বাচনে দলটির অবস্থান বরাবরই ভালো থাকে। অপরদকে বিএনপির ও গ্রহণ যোগ্যতা কোন অংশে কম নয়। তৃণমূলে তাদের ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। কিন্তু বিএনপি জামাতের রাজনৈতিক টানাপোড়ন, নিজেদের মধ্যে অনাস্থা ও জোটগত নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্ষীণ থাকায় আবারো সরকার গঠনে আওয়ামী লীগ এগিয়ে,এটি বিএনপি জামাতের অনেকের ই আশঙ্কা।
এব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নাসির উদ্দিন খান এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা এখন জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত আছি। জাতীয় নির্বাচনের এখনো এক বছর সময় বাকী আছে।বিভিন্ন আসনে দলের প্রার্থীদের বিষয়ে সাংগঠনিক ভাবে কোন আলাপ হয়নি এখনো। তিনি জানান, সিলেট ৬ সংসদীয় আসনে নুরুল ইসলাম নাহিদ ইলেকশন করলে তিনি সরে দাঁড়াবেন।
সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ইমরান আহমদ চৌধুরী বলেন,প্রত্যেকটি আসনে আমাদের ১০ জন করে প্রার্থী আছেন। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না। আমরা গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছি। দেশে নির্বাচনের কোন পরিবেশ নেই। আগে এটি ফিরিয়ে আনতে হবে। বিএনপি জামায়াত এর জোট বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এটি আমাদের মহাসচিব যা বলেছেন তাই আমাদের বক্তব্য। বিএনপি মনে করলে তিনিও নির্বাচন করতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান।
সিলেট জেলা জামাতের নায়েবে আমীর উপাধ্যক্ষ সৈয়দ ফয়জুল্লাহ বাহার বলেন,আমরা দলীয়ভাবে সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীদের অফিসিয়াল কোন ঘোষণা এখনো দেইনি।সোস্যাল মিডিয়ায় ৪টি আসনের চারজনের নাম এসেছে মাত্র। দলের আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা এখনো হয়নি। জোটগত ইলেকশনের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটি কেন্দ্রের জাতীয় নেতারা বলবেন। এ বিষয় আমরা বলতে পারছি না।
রাজনীতিতে কৌশল থাকতেই পারে। সিলেটে বিএনপি ও জামায়াত কৌশলগত ভাবেই এগুচ্ছে বলে অনেকের ই ধারণা। তবে সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপার্সন তারেক রহমান ও জামায়াত আমীর শফিকুর রহমানের মেসেঞ্জার চ্যাট সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের আলাপ আলোচনায় জোটগত নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই বলে ধারণা করছেন অনেকেই। তারেক রহমান ৮৬ ও ৯৬ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এর সাথে জামায়াতের আতাতের কথা স্মরণ করে দেন জামায়াত আমীর কে। জামায়াত ও বিএনপির বিভিন্ন বিষয়ে বিমাতাসুলভ আচরণের কথা মনে করিয়ে দেয়।