সিলেটে স্যালাইন সংকট, সরবরাহে ঘাটতি

সিলেট

সিলেটে মাস দেড়েক ধরে নরমাল (এনএস) স্যালাইনের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। নগরের ওষুধের দোকানগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে না স্যালাইন। বাজারে আইভি স্যালাইনের সরবরাহ কম থাকার পাশাপাশি, আছে দাম বেশি নেয়ারও অভিযোগ। এতে করে দেড় মাস ধরে সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা মুমূর্ষু ও সার্জারির রোগী ও স্বজনরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। শুধু সিলেট নগর নয়, পুরো জেলাজুড়েই ইনজেক্টেবল নরমাল স্যালাইন সরবরাহে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জানা যায়, কৃত্রিম স্যালাইন সংকট সৃষ্টি করে সংঘবদ্ধ চক্র ক্রেতার কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ।

দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পর থেকে বাজারে এই স্যালাইন স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ চাহিদা বেড়ে গেছে। আর এর সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বাজারে সংকট তৈরি করে বেশি দামে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফার্মেসি-সংশ্লিষ্টদের দাবি, চাহিদার তুলনায় স্যালাইনের সরবরাহ কম। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে না পারায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

দেশের বাজারে বাজারজাতকৃত বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পর বাজারে নরমাল স্যালাইনের চাহিদা বেড়ে যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের এই স্যালাইন দিতে হচ্ছে। হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে চরম সংকট তৈরি হয়েছে। কোম্পানিগুলো বাজারের চাহিদা অনুপাতে উৎপাদন করতে পারছে না। আবার কেউ কেউ বলছেন নরমাল (এনএস) স্যালাইন তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামালের সংকটের কথা।

দেশের বাজারে মূলত নরমাল স্যালাইনের যে চাহিদা রয়েছে, তার সিংহভাগ যোগান দেয় লিবরা ইনফিউশনস লিমিটেড, ওরিয়ন ইনফিউশন ও পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। কোম্পানিগুলো সাধারণত ডিএ, নরমাল, ডিএনএস, এইচএস, সিএস স্যালাইন বাজারে সরবরাহ থাকে। আর অপারেশনসহ সাধারণ রোগে আক্রান্তদের এই স্যালাইন প্রদান করা হয়। তবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পরই দেশে স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ, এদিকে চাহিদা বাড়ার পর থেকে দেশের বাজারে কমতে শুরু করে সরবরাহ। বর্তমানে দেশের বাজারে নরমাল স্যালাইনের সরবরাহ কমেছে ৮০ শতাংশ।

সিলেটের এম এ জি ওসমানী হাসপাতালে ভর্তিরত আয়েশা আক্তারের জন্য চিকিৎসক নরমাল স্যালাইন লিখেছেন কিন্তু হাসপাতালের নীচের কয়েকটি ফার্মেসিতে নরমাল স্যালাইন না পেয়ে বেশ কয়েকঘন্টা ঘোড়াঘোড়ির পর তার এক স্বজন একটি ফার্মেসী থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে স্যালাইন কিনেছেন। এমনটাই জানিয়ে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, ৮৭ টাকা দামের স্যালাইন তিনি ৫০০ টাকায় কিনে এনেছেন।

শুধু আয়েশা আক্তারই নন, স্যালাইন সংকটের কারণে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু, সার্জারি, ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন রোগীকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো তীব্র স্যালাইন সংকটে ভুগছে। তবে সম্প্রতি দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্যালাইন সংকট কাটলেও বেসরকারি হাসপাতালে সংকট এখনও কাটেনি।

রোগীদের অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট উইমেনস মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও নর্থ ইষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার বিভিন্ন ফার্মেসিতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ ফার্মেসিতেই স্যালাইনের ঘাটতি রয়েছে। তার মধ্যে অনেকেই ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে নরমাল স্যালাইন বিক্রি করছে। যদিও স্যালাইনের নির্ধারিত বাজারমূল্য ৮৭ টাকা।

এ ব্যাপারে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার সীতা ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী গোপাল চন্দ্র সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, সিলেটে চাহিদা অনুযায়ী কোম্পানিগুলো স্যালাইন সরবরাহ করতে পারছে না। এতে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। কিছু ব্যবসায়ী ওষুধ কোম্পানি থেকে সরাসরি সরবরাহ পেলেও সাধারণ দোকানিরা মোটেই স্যালাইন পাচ্ছে না। এতে নরমাল (এনএস) ৮৭ টাকার স্যালাইন কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

তিনি আরও অভিযোগ করে বলেন, সাধারণ দোকানিরা না পেলেও নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ব্যবসায়ীর কাছে স্যালাইনের মজুত রয়েছে। তারা কোম্পানি থেকে সরাসরি কিনে নিচ্ছে। পরে বাজারে সংকট তৈরি করে অধিক দামে বিক্রি করছে। তাই সাধারণ দোকানিরা স্যালাইন সরবরাহ পাচ্ছে না। ক্রেতারা না পেয়ে ফেরত যাচ্ছে। অনেকেই রোগীর জন্য জরুরি প্রয়োজনে নানা জায়গায় খোঁজাখুঁজির পরও স্যালাইন পাচ্ছে না।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, সিলেট মহানগরের সহকারী পরিচালক শ্যামল পুরকায়স্থ সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, ‘আমরা গত সপ্তাহেও সিলেটের বাজারে অভিযান চালিয়েছি, তবে যে ফার্মেসীতে স্যালাইন ছিল না বলেই জানিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। তবে এখন থেকে নিয়মিত অভিযান চালানো হবে। এ বিষয় কোনও অনিয়ম পাওয়া গেলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। স্যালাইনের গায়ে যে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য দেওয়া আছে, তার চেয়ে এক টাকাও বেশি বিক্রি করা যাবে না। যদি বেশি দামে স্যালাইন বিক্রি হয়, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো আমরা।’

এ ব্যাপারে লিবরা ইনফিউশনস লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপক (ইন্সট্রুমেন্টেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল) ইঞ্জিনিয়ার রাইসুল ইসলাম সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার কারণে কোম্পানি থেকে যে স্যালাইন তৈরি হচ্ছে তা দিয়ে সারাদেশের চাহিয়া মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোরকে বলেন, সারাদেশেই নরমাল স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। সেই প্রভাব আমাদের সিলেটেও পড়েছে। এদিকে মাঝখানে সিলেটে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেড়ে গিয়েছিল, সেসময় চিকিৎসা সেবা দিতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে আমাদের। আর গত সপ্তাহে সিলেটে অগ্নিদগ্ধ হয়ে আসা রোগীদের প্রচুর পরিমাণে স্যালাইন লেগেছে। সেটাও কুলিয়ে উঠেছি। তবে আশা করা যাচ্ছে আগামী শনিবার থেকে এ সংকট কেটে যাবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *