সুষ্ঠু নির্বাচনে আইন বাধা হতে পারে না

মুক্তমত

বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকাই মুখ্য। এটা আমরা অতীতের নির্বাচনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেখেছি। এই দেশে নির্বাচন কমিশন তখনই স্বাধীন ভূমিকা রাখতে পারে, যখন নির্বাচনকালীন সরকার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকে। এটা বাংলাদেশের বিগত সময়ের তত্ত্বাবধায়ক এবং দলীয় সরকার– এই দুটি আমলের নির্বাচনের তুলনামূলক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বুঝতে পারা সহজ হবে। সোজা কথায়, নির্বাচন কেমন হবে তা নির্ধারিত হয়ে যায় নির্বাচনকালীন সরকারে কারা থাকেন তা দেখে। এখন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে সমস্যা, সেটাই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) কী আছে, কী পরিবর্তন হবে এসবের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে– নির্বাচনকালীন সরকারে কারা থাকছেন, সেটি আগে দেখতে হবে।

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ যখন সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার কথা বলেছিল। যদি কারও ইচ্ছা থাকে সুষ্ঠু নির্বাচন, যদি ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছা থাকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার– সেটি সুষ্ঠু হবে। কীভাবে করবে, কোন প্রক্রিয়ায় করবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ইচ্ছা ঠিক থাকে তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব। তাহলে আইনে কী আছে, কী করা যাবে, কী করা যাবে না– এসব তখন বাধা তৈরি করতে পারে না।

১৯৯১ সালে সংবিধানের বাইরে গিয়ে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে, আবার ওয়ান-ইলেভেনের সময়েও আমরা সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করেছি। এখন যদি বলা হয়, সংবিধানে এটা আছে, এটা করা যাবে না; আদালতের রায়ে এটা আছে, এটা করা যাবে– এসব গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তাই যেটা সবচেয়ে জরুরি, নিয়ত ঠিক করে নির্বাচনটি সঠিকভাবে করা। সংবিধান সংশোধন কিংবা আইন পরিবর্তন আগেই জরুরি নয়।

এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন একটি সরকার তৈরি করা যেতে পারে। সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে যিনি তুলনামূলক সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সৎ মনে হবে তাঁকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান করা অবশ্যই সম্ভব। গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের (জি এম কাদের) মতো একজনকে সংবিধানের মধ্যে থেকেই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে করা যায়। কারণ তিনি সংসদ সদস্য আছেন। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন সরকারের টেকনোক্র্যাট মিনিস্টার হিসেবে বিএনপির কাউকে বা বিএনপির মনোনীত কাউকে এবং নির্দলীয় কাউকে অন্তর্ভুক্ত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এসবের প্রক্রিয়াটি কঠিন নয়, উদ্দেশ্যটা ঠিক রাখাই হচ্ছে আসল।

এখন আরপিও সংশোধনের নামে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে কমিশনের শক্তি আরও বৃদ্ধি করার দরকার ছিল, সেখানে কমিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে। কমিশন নিজেও উদ্যোগ নিচ্ছে না আবার যতটুকু ক্ষমতা আছে, সেটাও কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে আমরা অতীতে দেখেছি, নির্বাচন কমিশন নিজেও আবার ব্যর্থ হয়। দেখা যায় কমিশন কাউকে মনোনয়ন দিল না, সেই ব্যক্তি আদালতের নির্দেশনা নিয়ে আবার মনোনয়ন ফিরে পায়। তৃণমূল বিএনপি নামে একটি দলকে আমরা নিবন্ধন পেতে দেখেছি।

নির্বাচন কমিশন নিজেও এমন কিছু আইন করেছে, যাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। যেমন বলা যায়– ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আনার মাধ্যমে কমিশন নিজেও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ বন্ধ করছে। নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠানকে আমরা উদ্যোগী এবং আন্তরিক হয়ে এগিয়ে আসছে এটা দেখতে চাই। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো আন্তরিক উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। পাশাপাশি সরকারের নির্বাহী বিভাগকে দেখছি, প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা খর্ব করার তৎপরতায় রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে এসব উদ্বেগজনক।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *