সেদিন চোখের সামনে কিয়ামত দেখেছি’ – সুলতান মনসুর।

মৌলভীবাজার

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি। ১৯৯৬ সালে মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১/১১ পর সুলতান মনসুর চলে যান দলীয় স্রোতের বাইরে। হারান দলীয় পদ-পদবি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে একই আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর জোটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নিতে যান সংসদে। বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে অনেকটা কোনঠাসাই তিনি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বর্ণনা ও কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’ গঠন ও ’৭৫ পরবর্তী সময়ে দেশের চিত্র জানতে সেলিম আহমেদ মুখোমুখি হোন সুলতান মনসুরের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেলিম আহমেদ। � �প্রতিবেদক: আপনি ২১ আগস্টের প্রত্যক্ষদর্শী, সেদিন কী ঘটেছিল?�সুলতান মনসুর: দিনটি ছিল শনিবার। বিকেলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমাবেশ। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সমাবেশে অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্যের শেষান্ত। তখন আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৫টা। হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল নারকীয় গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে লাগল একের পর এক গ্রেনেড । বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহুর্মুহু গ্রেনেড হামলার বীভৎসতায় রক্ত-মাংসের স্তুপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। আসলে এটা একটা বিভীষিকাময়। কারবালার ইতিহাস আমরা পড়েছি, কিন্তু ২১ আগস্ট কারবালাকেও ম্লান করবে। আমরা যারা বেঁচে ফিরেছি, তারা কিয়ামত থেকে রাজকীয়ভাবে ফিরে এসেছি। গ্রেনেডের স্প্লিন্টার আজও শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছি। ক্ষমতাসীন বিএনপি জোট এই গ্রেনেড হামলা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ একটা জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের একটা ষড়যন্ত্র ছিল। নানা সময় নানা পটপরিবর্তনের কারণে বিভিন্নজন বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় এসেছিল। এই পট পরিবর্তনের একটি অংশ ২১ আগস্ট। তবে এই বিভীষিকাময় ঘটনা কখনো রাজনৈতিক ভাষায় মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। ১৫ আগস্টের মতো আরেকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করতে চায়, ধ্বংস করতে চায় সেই বিএনপি সরকার এই জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছিল। সেমসয় দেশে মানুষের যে নিরাপত্তা নেই তা দেশি-বিদেশিদের কাছে প্রমাণ হয়েছিল। বিএনপি যে একটা গণবিরোধী শক্তি বা বিএনপির মধ্যে একটা জঙ্গি রাজনৈতিক দল তাও বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ হয়েছিল।

প্রতিবেদক: বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে দেখেছিলেন?�সুলতান মনসুর: আমি রাজনীতি শুরু করি ১৯৬৭-৬৮ সালে। তখন মৌলভীবাজার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। সেই সময় পেপার-পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর খবর পড়তাম। তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল ইত্তেফাক। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের হওয়ার পর তিনি যখন প্রথম মৌলভীবাজার এসেছিলেন তখন তাকে আমি প্রথম সরাসরি দেখি। তিনি মৌলভীবাজারের শাহ মোস্তফা রোডের ওয়াপদা রেস্ট হাউজে উঠেছিলাম। বিকেলে আমরা মৌলভীবাজার গভরমেন্ট স্কুল মাঠে খেলাধুলা করছিলাম, হঠাৎ শুনলাম শেখসাব (বঙ্গবন্ধু) মৌলভীবাজার এসেছেন। আমরা তাকে দেখার জন্য ছুটে গেলাম। দূর থেকে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ভরে দেখলাম। দ্বিতীয়বার দেখলাম ’৭০ এর নির্বাচনের সময়। তখন রমজান মাস ছিল। জেনারেল এমএ গনি ওসমানীর নির্বাচনী প্রচারণা শেষে তৎকালীন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী বঙ্গবন্ধুকে মৌলভীবাজার নিয়ে এসেছিলেন। আমরা তখনকার মৌলভীবাজার জেলা ছাত্রলীগের নেতাদের নেতৃত্বে শেরপুর ফেরিঘাট থেকে রিসিভ করলাম। তখন জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলেন মুজিব ভাই, মতি ভাই (মতিউর রহমান চৌধুরী), সজল ভাই, ওদুদ ভাই (আব্দুল ওদুদ) উল্লেখযোগ্য। আমি তখন জয় বাংলা বাহিনী (ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী) করতাম। সেই সময় বিশাল এক ব্যাপার। তিনি আসার কথা সন্ধ্যায় কিন্তু এসেছেন রাত ১০টায়। কিন্তু শেরপুর থেকে মৌলভীবাজার প্রায় ১২ কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে পুরুষ-মহিলাসহ সর্বস্তরের হাজার মানুষ হারিকেন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। অন্ধকার থাকায় গাড়িতে থাকা বঙ্গবন্ধুকে দেখা যাচ্ছে না তবে আবেগপ্রবণ মানুষ গাড়িতে হাত লাগিয়ে সেই ছোঁয়া বুকের মধ্যে লাগাতে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু সেবার এসে মৌলভীবাজার পিটিআই বাংলোতে উঠেছিলেন। বন্ধবন্ধু পরদিন কমলগঞ্জ, শমসেরনগর হয়ে বড়লেখায় নির্বাচনী প্রচারণায় গেছেন। সেখানে থেকে কুলাউড়া হয়ে এসে মৌলভীবাজারে নির্বাচনী সভায় যোগদান করেছেন। সভা শেষে শ্রীমঙ্গল হয়ে হবিগঞ্জ যাওয়ার পথে শুনলাম বঙ্গবন্ধুকে মুসলিমলীগ নেতা চেরাগ মিয়ার ছেলের নেতৃত্বে কালো পতাকা দেখানো হবে। খবরটি গাজী সাহেব (দেওয়ান ফরিদ গাজী) বলছেন, সিলেটে কী বঙ্গবন্ধু অসম্মানিত হয়ে যাবেন। তারপর জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আমার মিছিল সহকারে রাতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত গেলাম। বঙ্গবন্ধু রাতে শ্রীমঙ্গলে সভা করে চলে গেলেন হবিগঞ্জে। এরপর মুক্তিযুদ্ধ হলো, দেশ স্বাধীন হলো। আমি সিলেটে ছাত্র রাজনীতি শুরু করলাম। এমসি কলেজের (মুরারিচাঁদ কলেজ) ভিপি হলাম। সিলেট বঙ্গবন্ধু এলেন আরও দুইবার দেখা হলো। শেষবার সরাসরি দেখলাম ১৯৭৫ সালের ৪ জুলাই। আমি তখন মদনমোহন কলেজের ভিপি ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তখনকার সময় সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান ও সাবেক ছাত্রনেতা বাবলু হোসেন বাবুলের সঙ্গে গণভবনে দেখা করতে এসেছিলাম। বঙ্গবন্ধুতো তখন আমাকে সরাসরি চিনতেন না আর সেই বয়সে চেনারও কথা না। তবে বাবলু ভাইকে চিনলেন। বাবলু ভাই একটা রাজনৈতিক মামলা সংক্রান্ত কাজে এসেছিলেন। এরপরতো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। আমরা প্রতিবাদে সংগঠিত হলাম।� �প্রতিবেদক: বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কাদের সিদ্দিকীর ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’তে আপনার ভূমিকা কী ছিল?�সুলতান মনসুর: বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রতিরোধ যুদ্ধ করার জন্য আমাদের সংগঠিত হতে বলা হলো। আমরা সীমান্ত এলাকায় গেলাম। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রমতি গান্ধীর সহযোগিতায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ’৭৫ সালের নভেম্বর মাসে ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’ গঠন করা হলো। যুদ্ধ শুরু হলো ভারতের মেঘালয় প্রদেশের তুরা জেলার চান্দুভূই নাম স্থানে আমাদের ক্যাম্প ছিল। হেডকোয়ার্টারে ৩৬ জন কমান্ডার ছিলেন। আমি তথ্য ও প্রচার বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম। আমার কাজ ছিল পত্রিকা বের করা ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো। আবার সেই সংবাদ লেখিয়া জার্মানির মাধ্যমে লন্ডনে গফফার চৌধুরীর কাছে পাঠাতাম। সংবাদগুলো বাংলার ডাক ও ইংরেজি সানরাইজ পত্রিকায় প্রকাশ হতো। এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর ভারতের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে আমাদের কার্যক্রম বন্ধ হলো। আমাদের ১০-১২ হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হলো। তবে আমাদের ৬-৭ কমান্ডারকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকতে দেওয়া হলো। এর এক-দেড় বছর পর আমি দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হলাম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আমাকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বানালেন। ছাত্রদের প্রত্যক্ষ ভোটের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসুর) ভিপি হলাম।

প্রতিবেদক: ’৭৫ পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা কী ছিল?�সুলতান মনসুর: সেটা আপনারা কল্পনাই করতে পারবেন না। বেঈমান খন্দকার মুশতাকের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পৈশাচিক ব্যবহার। মুক্তিবাহিনীতে যারা গেছে জিয়াউর রহমান গ্রেফতার করেছে। এককথায় একটা জঙ্গি শাসন ব্যবস্থা শুরু করেছিল। আমরা দুই-আড়াই বছর ভারতে ছিলাম; যেখান থেকে এসে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। আমাদের আগেও যারা দেশের ভেতরে ছিলেন তারা আরও বেশি করেছেন। জিয়ার দুঃশাসনের আমলে ৯৯ শতাংশ জায়গায় কোনো ভোট হয়নি। জাতীয় নির্বাচনের নামে পাতানো খেলা হয়েছে। জিয়া মারা যাওয়ার পর কিছুদিন সাত্তার সাহেব ছিলেন রাষ্ট্রপতি। এরপর জিয়ার কায়দায় জেনারেল এরশাদও ক্ষমতায় এলেন। ক্ষমতায় এসে টানা ৯ বছর ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। তারপর আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে এরশাদের পতন হলো। স্বৈরশাসক এরশাদের এই দীর্ঘ ৯ বছর আমাদের নানা আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেলিম, দেলোয়ার, জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, মোজাম্মেল, আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজ উদ্দিন আহমেদ, শ্রমিক নেতা তাজুল ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রকামী মানুষকে হারিয়েছি। এরপর তিন দলীয় জোটের রূপরেখার মাধ্যমে ’৯১ সালের নির্বাচন হলো। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করল। বিএনপিও শুরু করল ভোট চুরির রাজনীতি। এরপর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করল। অমাবস্যার কালো অন্ধকার ভেদ করে বাংলাদেশ ফিরল মূল স্রোতে।

প্রতিবেদনঃ সেলিম আহমেদ

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *