প্রায় ৩০ বছর আগের কথা, তুরস্কের করিৎকর্মা প্রেসিডেন্ট তখন ইস্তাম্বুলের মেয়র। মানুষের খেদমতে রাত দিন চষে বেড়ানো এবং সাধ্যানুযায়ী সমস্যার সমাধান করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও মানুষের ভাগ্য বদলই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য।
ইসলামী ছাত্র শিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ও তাঁর কতিপয় সাথী ইস্তাম্বুল গিয়েছেন আমন্ত্রিত হয়ে। মেয়র রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের সাথে সাক্ষাৎ এর নির্ধারিত সময়ের ৫-৭ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। ডেলিগেটরা অপেক্ষমান। ইতোমধ্যে তিনি হন্তদন্ত হয়ে হলে প্রবেশ করলেন। পবিত্র হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনকারী হাজীদের বাসায় বাসায় গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে কিছুটা দেরী হয়ে যাওয়ায় অতিথিদের কাছে বিনীত ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
তিনি এখন শুধু তুরস্ক নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের সমৃদ্ধি, শৌর্য্য-বীর্য পুনুরুদ্ধার ও আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। রাজধানীর বস্তিবাসীদের সাথে হঠাৎ করে ইফতারে শরীক হওয়া, নাতীকে সুললিত কন্ঠে কুরআনের তেলাওয়াত শিখানো সহ রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক আবশ্যিক দায়িত্ব পালনেও তিনি সরব-সদা সচেতন।
হ্যা, প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশেও আমরা একজন আদর্শবাদী, সদা সচেতন, দূরদর্শী এরদোয়ান চাই। মা শা আল্লাহ, হ্যা আমি/আমরা একজন এরদোয়ানের পদচারণা, একজন রজব তাইয়্যেবের প্রতিচ্ছবি বাংলায় দেখতে পাচ্ছি। তাঁর দুটো দিনের কর্ম তৎপরতার সাথে আমি ওতপ্রোতোভাবে জড়িত থাকায় খানিকটা বিবরণ দিচ্ছি। দেখুন আপনারাও হয়তো আমার মতো আশান্বিত হতে পারেন, স্বপ্ন দেখতে পারেন।
এবারে মাস দিনের ব্যাবধানে বন্যায় দুইবার বিধ্বস্ত হলো সিলেট-সুনামগঞ্জ। প্রথম বারের চেয়ে দ্বিতীয়টি আরো বেশি ভয়াবহ, আরো সর্বগ্রাসী। যা শতাব্দির রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
প্রথম বন্যার সময় রাহবার আসবেন। সফর সঙ্গী হতে হবে। সকাল আট টায় কথামতো বাসার নিকটস্থ সুনামগঞ্জ মহা সড়কে অপেক্ষমাণ। মাত্র তিন মিনিট পরেই গাড়ি হাজির। ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ছাতকের গোবিন্দগঞ্জে পৌছলাম। স্থানীয় দায়িত্বশীল নেতা কর্মী সাথে নিয়ে নৌকাযোগে পানি বন্দী দূর্গম একটি গ্রামে পৌঁছে হাঁটু পানি মাড়িয়ে একটি পাঠশালার বারান্দায় দাড়িয়ে স্থানীয় ভাষায় বন্যা দূর্গতদের প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা বোধক কিছু বক্তব্য রাখলেন। আমরা যারা তাঁর সাথী তাদেরকেও কিছু কথা রাখতে নির্দেশ দিলেন। সহায়তা বিতরণ হলো। বাকি কাজ স্থানীয়দের সমজিয়ে দিয়ে ছুটলেন পরবর্তী গন্তব্যস্থল প্রায় ৫০/৬০ কিলোমিটার দূরে বন্যাক্রান্ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নির্ধারিত স্পটে।
অতঃপর সারাদিন একে একে গোয়াইনগাট, জৈন্তা, কানাইঘাট, সিলেট সদর সহ মোট ছয়টি উপজেলার ছয়টি স্থানে তড়িৎ কর্মসূচী সমাপ্ত করলেন। একেকটি স্পট থেকে আরেকটি স্পট গড়ে ২৫/৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বাহন ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় গাড়ি এবং কখনো নৌকা। সন্ধ্যায় বিমানে ঢাকা প্রত্যাবর্তন, অতঃপর রাতে দলীয় মিটিং এ অংশগ্রহন।
দ্বিতীয় বারের বন্যায় সুনামগঞ্জের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ছাতক দোয়ারায় সফর করবেন। সকালে বিমানযোগে রাহবার ও তার সফর সঙ্গীরা সিলেট পৌঁছলেন। সড়কের ধারে একজন দায়িত্বশীলের বাসায় সফর সঙ্গীদের নিয়ে নাস্তা পর্ব সারলেন। অতঃপর রেস্ট না নিয়েই ৩০ কিলোমিটার দূরে বন্যা বিধ্বস্ত সড়ক পথে ছাতক পৌঁছলেন নির্ধারিত সময়ে। স্থানীয় জেলা উপজেলা নেতৃবৃন্দ দের নিয়ে বিশাল একটি ইঞ্জিন নৌকা যোগে সুরমা ও চেলা নদীর অথৈ জলরাশি পাড়ি দিয়ে ছাতকের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ইসলামপুর ইউনিয়নে পৌছলেন। নির্ধারিত স্পটে শত শত নারী-পুরুষ, শিশু কিশোরদের উপস্থিতিতে সফরসঙ্গী কেন্দ্রীয় এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এইচ এম আব্দুল হালিম, এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তর আমীর জনাব সেলিম উদ্দিন, সুনামগন্জ জেলা আমীর মাওলানা তোফায়েল আহমদ খাঁন, জননেতা অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুস সালাম আল মাদানি বক্তব্য রাখার পর অতিথি মঞ্চ থেকে আমীরে জামায়াত দর্শক সারি বা জনতার কাতারে চলে আসলেন, অস্বচ্ছল বিপর্যস্ত লোকজনকে নিজের কাছে দাঁড় করালেন, সান্ত্বনা দিলেন, সাহস জোগালেন, শিশুদের মাথায় হাত বুলালেন, বৃদ্ধদের কপালে চুমু দিলেন, স্থানীয় ভাষায় আবেগময়ী বক্তব্য রাখলেন, নারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রদর্শন করলেন, সহায়তা সামগ্রী ক্ষতিগ্রস্তদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌছে দেবার কথা ছিল কিন্তু সময়স্বল্পতার কারনে তা করতে না পারায় দুঃখপ্রকাশ করলেন, বেশী বয়সী মায়েদের উপহার স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। ভবিষ্যতেও সাধ্যানুযায়ী পাশে থাকার আশ্বাস দিলেন।
২য় গন্তব্য দোয়ারা বাজার উপজেলার সদর ইউনিয়নের টেবলাই বাজার। পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় লাফার্জ সুরমা সংলগ্ন খালের ব্রীজের নিচ দিয়ে বড় নৌকা অতিক্রম করতে পারবে না তাই তুলনামূলক ছোট দুইটি নৌকা যোগে যাত্রা শুরু হলো। বিশাল হাওর পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছলাম। অপেক্ষমাণ হাজারো মানুষ প্রিয় রাহবারকে স্বাগত জানালো। সময় মতো কর্মসূচি সমাপ্ত হলো। নামাজ, দুপুরের খাবার, কুশল বিনিময়, সহযোদ্ধাদের খবর, এমনকি মেজবানের বাড়ির মহিলাদের সালাম জানানো কিছুই বাদ যায় নি তাঁর কর্মসূচির অংশ থেকে।
৩য় গন্তব্য আরো দশ কিলোমিটার পশ্চিমে মান্নারগাও ইউনিয়নের কাটাখালী নামক স্থানে সুরমার তীরে। যথা সময়ে উপস্থিতি, বক্তব্য, সহায়তা বিতরণ, কুশল বিনিময় অতঃপর বিদায়। আবারো ছাতক থেকে গাড়ি যোগে সিলেট প্রত্যাবর্তন। রাস্তায় মাগরিবের সালাতে সম্মানিত ইমাম ও মুসল্লীদের অনুরোধে ইমামতি। সিলেট পৌঁছে ২/৩ টি ত্রাণ বিষয়ক সাংগঠনিক বৈঠকে অংশগ্রহন।
ঈদ-উল-আদ্বহা উদযাপন
দোয়ারা বাজার সফরকালে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন ইন শা আল্লাহ এবার সুনামগঞ্জ বাসীদের সাথে ঈদ উদযাপন করবেন। যেখানে ভোগবাদীরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাসজিদে ঈদ জামাত আদায় করে, বক্তব্য বিবৃতি প্রদান করে, মুখরোচক খাবার গলধঃকরণ করে ঈদ উৎসব পালন করে সেখানে ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালার স্ত্রী,পুত্র, কন্যা মিলিয়ে গোটা ৫ সদস্যের চিকিৎসক পরিবার অন্তত ঈদ তো বাসায় করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু না, তিনি কথামতো সুনামগঞ্জে ঈদের জামাত আদায় করলেন। স্পীড বোট যোগে তাহিরপুর-বিশম্ভরপুর উপজেলার বন্যাক্রান্ত দুস্থ দের দেখলেন, সহায়তা করলেন, নিজ অর্থায়নে নিজ হাতে কুরবাণী করলেন, ইতিহাস গড়লেন। অতঃপর সন্ধ্যায় সিলেট ফিরলেন।
হ্যা- তিনি কোথায় নেই? নৌকাডুবিতে নিহত কিশোরগঞ্জের ১৭ হাফিজের পাশে, বাস দূর্ঘটনায় নিহত উত্তরবঙ্গের ১৩ জন ব্যাক্তিদের স্বজনদের পাশে, সীতাকুন্ডে অগ্নিদগ্ধ ৫০ জন নিহতদের পাশে, বন্যার পানিতে ডুবে মৃত্যু বরনকারী সুনামগঞ্জের প্রায় অর্ধশত ব্যাক্তির স্বজনদের পাশে, রোগাক্রান্ত আলেম-ওলামা-মাশায়েখদের পাশে, আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত মাদারিস ও ইয়াতিমখানার পাশে। শুধু মানুষ নয় বোবা পশু প্রানীর খাদ্য সহায়তা দানে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ ছাত্র ছাত্রীদের পাশে, ক্ষতিগ্রস্থ ইমাম মুয়াজ্জিনদের পাশে সর্বত্রই তিনি সাধ্যানুযায়ী এক পায়ে দাড়িয়ে।
তাই বলছিলাম বাংলায় আমি একজন রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি দেশ ও জাতিকে নিয়ে সুখী সমৃদ্ধশালী দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মানের একজন সিপাহসালারের প্রতিচ্ছবি। দেখতে পাচ্ছি শত জেল জুলুম, নির্যাতন, শাহাদাতের পেয়ালা পান করার পরও পাহাড়ের মতো অটল, অনড় একজন মহীরুহের প্রতিচ্ছবি। দেখতে পাচ্ছি স্রষ্টায় নিবেদিত বিনর্ম একজন আবেদের প্রতিচ্ছবি। দেখতে পাচ্ছি উম্মাহর কল্যাণকামী উলামা মাশায়েখদের ঐক্য প্রত্যাশী একজন মর্দে মুমিনের প্রতিচ্ছবি। দেখতে পাচ্ছি অসহায় দূর্গত মানবতাঁর স্বার্থে নিয়োজিত একজন রাস্ট্র নায়কের প্রতিচ্ছবি। দেখতে পাচ্ছি সর্বোপরী একজন মুহসিন,মুত্তাকী তথা আল্লাহ ওয়ালার প্রতিচ্ছবি।
আসুন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। সহায়তা করি নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে,মেধা দিয়ে, অর্থ দিয়ে, শ্রম দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে, অনৈক্য ও সংকীর্ণ দলাদলি , ফতোয়াবাজী পরিহার করে। সীসাঢালা প্রাচীরের মত একতাবদ্ধ হয়ে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন এবং সৎ লোকের শাসন কায়েমের প্রচেষ্টায় তার সঙ্গী হই, অন্তত নিজ নিজ অবস্থানে থেকেও একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যপানে অগ্রসর হই।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ও তাঁর সাথীদের হেফাজত করুন। হায়াতে ও তার কর্ম তৎপরতায় বারাকাহ দান করুন, আমীন।
শেয়ার করুন