মোটরসাইকেল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে অনেকদিন ধরে। দেশে মোটরসাইকেল নিয়ে খটরমটর বেশ ভালোই হচ্ছে। এই খটরমটর লেগে যাওয়ার বেশকিছু কারণও আছে এবং এটা একসময় যে হতোই তা অনেক আগে থেকেই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন।
আমরা জানি যে, আমাদের দেশে পরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ করা হয়নি ফলে দেখা যাচ্ছে যে এখন বিভিন্ন কারণে ভূমি স্বল্পতা বা অপব্যবহারের কারণে চাইলেও আমরা সড়কের পরিমাণ বাড়াতে পারব না।
আবার অন্যদিকে সড়ক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই অল্প পরিমাণ সড়কে বেশি পরিমাণ ব্যবহারকারীদের জায়গা দিতে হলে আমাদের কৌশলী হতে হবে। এমন পরিবহন ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করতে হবে যেগুলো অল্প জায়গায় অনেক যাত্রী বা পণ্য পরিবহন করতে পারে।
এরফলে একই সময়ে, অল্প স্থান দখল করে, অনেক মানুষকে সেবা দেওয়া যাবে এবং এতে করে সড়কের যে সীমাবদ্ধতা আছে তা এড়ানো যাবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনায় আমরা উল্টো চিত্র দেখি।
বাংলাদেশে মোট ১৯ ধরনের অনুমোদিত যানবাহন রয়েছে (অন্যান্য ধরন বাদে) এবং বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)-এর সর্বশেষ হিসাব অনুসারে ১১ বছরে মোটরসাইকেল ব্যতীত সব ধরনের যানবাহন বেড়েছে সর্বোচ্চ প্রায় দুই গুণ কিন্তু এর বিপরীতে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ।
বর্তমানে একটি প্রাইভেট কার-এর বিপরীতে মোটরসাইকেল আছে প্রায় ১০টি, একটি বাসের বিপরীতে মোটরসাইকেল আছে প্রায় ৭৪টি এবং একটি মিনিবাস (যা আমাদের নাগরিক যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন) এর বিপরীতে মোটরসাইকেল আছে প্রায় ১৩৫টি। এভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে যেকোনো বাহনের তুলনায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেশি।
বর্তমানে একটি প্রাইভেট কার-এর বিপরীতে মোটরসাইকেল আছে প্রায় ১০টি, একটি বাসের বিপরীতে মোটরসাইকেল আছে প্রায় ৭৪টি
যানবাহনের এই চিত্র যে শুধু আমাদের দেশেই দেখা যায় ব্যাপারটা তা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র ‘Global status report on road safety 2015’ অনুসারে পৃথিবীতে যত মোটরযান রয়েছে তার ২৯ শতাংশ হলো মোটরসাইকেল এবং এদের মধ্যে ৮৮ শতাংশ রয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত দেশগুলোতে।
ভিয়েতনামে মোট মোটরযানের ৯৫ শতাংশ হলো মোটরসাইকেল এবং সেখানে প্রতিদিন প্রায় ৭৫০০ মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। একই চিত্র আমরা দেখি থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ব্রাজিল, ভারত, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে।
উন্নত দেশগুলোতে মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয় বিনোদনের জন্য যা হলিডে বাইক নামে পরিচিত। অন্যদিকে উন্নয়নশীল ও নিম্ন আয়ের দেশে এই মোটরসাইকেল হলো যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের একটা মাধ্যম।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ৪০ শতাংশ মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয় পণ্য পরিবহনে আর ৬০ শতাংশ মোটরসাইকেল ব্যবহার হয় যাত্রী পরিবহনে। ব্রাজিলে মোটরসাইকেলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয় যানজট এড়ানোর জন্য আর দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে ৫৬ শতাংশ মোটরসাইকেল ব্যবহার হয় পণ্য পরিবহনের কাজে।
একটি বিশেষ ধরনের মোটরযানের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকতেই পারে কিন্তু পুরো পৃথিবীতে বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত দেশগুলোতে এই বৃদ্ধি সড়ক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
পুরো পৃথিবীতে একদিকে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের কাজে মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়ছে অন্যদিকে বাড়ছে এর সাথে সংশ্লিষ্ট সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাবে দেখা যায় যে, পৃথিবীতে মোট সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর ২৩ শতাংশ ঘটে মোটরসাইকেলের সংশ্লিষ্টতায় এবং উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে এই হার আরও বেশি। যেমন রিপাব্লিক অব তাঞ্জানিয়ায় ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৪২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৪ শতাংশ হয়েছিল আর এর বিপরীতে মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২২ শতাংশে।
একই সময়ে কম্বোডিয়াতে এই মৃত্যুর হার ছিল ৭০ শতাংশ এবং থাইল্যান্ডে ছিল প্রায় ৭৩ শতাংশ যদিও উন্নত দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া বা সাউথ কোরিয়াতে মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যুর হার ছিল ১৮ শতাংশের কম। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত মোটরসাইকেলের সংখ্যা যত বাড়ছে এই সংক্রান্ত মৃত্যুর হার ও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহারকারী’-র তালিকায় তিনটির মধ্যে একটি হলো মোটরসাইকেল। আমাদের দেশেও একই চিত্র দেখা যায়। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ যত মোটরযান রয়েছে তার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ হলো মোটরসাইকেল এবং একই সাথে এই সংক্রান্ত দুর্ঘটনার হার ও অনেক বেশি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এর দুর্ঘটনা রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এআরআই)-এর এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে মোটরসাইকেল এর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১০ লক্ষ (৩৪ শতাংশ) এবং একই সময়ে সংঘটিত দুর্ঘটনার মধ্যে মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনার হার ছিল পর্যায়ক্রমে ২৯ শতাংশ, ৩২ শতাংশ এবং ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই সংক্রান্ত দুর্ঘটনার সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
তর্কের খাতিরে আমরা হয়তো বলতে পারি যে, দেশে গড়ে ৭০ শতাংশ যানবাহন (মোটরসাইকেল) জড়িত হচ্ছে প্রায় ৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনার সাথে, যা আপাতদৃষ্টে অনেকের কাছে এখনো কম মনে হতে পারে কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ঠিক একইভাবে মোটরসাইকেলের সংখ্যাকে বাড়তে দেওয়াতে আজ অনেক দেশে এই দুর্ঘটনার হার ৭০ শতাংশের উপরে চলে গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, থাইল্যান্ডে ২০১৮ সালে সড়কে মোট মৃত্যুর প্রায় ৭৪ শতাংশ হলো মোটরসাইকেল আরোহী (Bangkok Post; Published : 22 OCT 2021 AT 05:00)। একই চিত্র পাওয়া যায় অন্যান্য দেশেও।
এছাড়াও ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের দেশে সব দুর্ঘটনা হিসাবের খাতায় আসে না বিশেষ করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলেই কেবল হয়তো তা রিপোর্ট করা হয় কিন্তু এর বাইরে আহত বা গুরুতর আহত হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা অজানাই থেকে যায়।
তাহলে যে মোটরযানকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ব্যবহারকারীদের তালিকায় রাখা হয়েছে এবং পুরো পৃথিবীতে এই সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক সেই বাহন কেন এবং কীভাবে আমাদের দেশে এত জনপ্রিয় হচ্ছে তা ভেবে দেখা দরকার।
ছোট গাড়ির সংখ্যা বাড়ে শহরে আর এভাবে ছোট গাড়ি যত বাড়ে তত শহরে যানজট বাড়ে, আর যানজট থেকে মুক্তি পেতে কিছু মানুষ আবার তাড়াতাড়ি যাওয়ার আসায় মোটরসাইকেল কেনে।
আমাদের দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধির বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মানুষের আয় বৃদ্ধি পাওয়া, পরিবহন স্বল্পতা, রাস্তার যানজট, গণপরিবহনের অপর্যাপ্ততা, অন্য পরিবহনের যাতায়াতের খরচ বৃদ্ধি, পার্কিং এর সহজলভ্যতা, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কম হওয়া, মোটরসাইকেল কোম্পানি বা বিক্রেতার লোভনীয় অফার ইত্যাদি।
সবকিছুর পরেও যে ব্যাপারটি মোটরসাইকেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে তা হলো যাতায়াতের জন্য অন্য মাধ্যমের বিশেষ করে গণপরিবহনের স্বল্পতা ও যানজট।
দিনের শুরুতে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় যে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে এবং একটি বাস কোনোমতে পেয়ে অনেকের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে যখন বাসে উঠে দেখে যে কোনো সিট ফাঁকা নেই, বরং পরিবেশ এমন যে ঘেমে নেয়ে তাকে অফিসে পৌঁছাতে হচ্ছে তখন সেই মানুষ চেষ্টা করে কিছু টাকা জমিয়ে বা ব্যাংক লোন নিয়ে একটি মোটরসাইকেল কিনতে।
এর ফলে ক্রমান্বয়ে ছোট গাড়ির সংখ্যা বাড়ে শহরে আর এভাবে ছোট গাড়ি যত বাড়ে তত শহরে যানজট বাড়ে, আর যানজট থেকে মুক্তি পেতে কিছু মানুষ আবার তাড়াতাড়ি যাওয়ার আসায় মোটরসাইকেল কেনে। এ যেন ‘ছোট গাড়ির দুষ্টচক্র’। এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হলে আমাদের কৌশলী হতে হবে।
লেখার প্রথমে মোটরসাইকেল এর সাথে অন্যান্য কিছু মোটরযানের তুলনা করেছিলাম সংখ্যার ভিত্তিতে এবং সেখানে দেখা গিয়েছে যে, একটি মিনিবাসের বিপরীত মোটরসাইকেল আছে প্রায় ১৩৫টি অথচ একটি মিনিবাস দিয়ে ৫০টি মোটরসাইকেল এর সমান যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব।
তার মানে গড়ে ১৩৫টি মোটরসাইকেল রাস্তা থেকে সরানোর জন্য মাত্র ৩টি মিনিবাস প্রয়োজন। ১৩৫টি মোটরসাইকেল চালক থাকবে ১৩৫ জন আর ৩টি বাসে চালক থাকবে তিনজন। এখন যদি সড়কের শৃঙ্খলার প্রশ্ন আসে তাহলে আপনি ১৩৫ জন চালককে নিয়ন্ত্রণ করবেন নাকি ৩ জন চালককে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
১৩৫ জন চালককে নিয়ন্ত্রণ করতে আপনার যে পরিমাণ সময়, শ্রম, বিনিয়োগ, লোকবল বা লজিস্টিক লাগবে তার তুলনায় ৩ জন চালককে নিয়ন্ত্রণ করতে এই সবকিছু কম লাগবে না বেশি লাগবে?
বাংলাদেশের জন্য কস্ট ইফেক্টিভ কোনটা হবে সেই প্রশ্ন নীতিনির্ধারকের কাছে রেখে গেলাম। নীতিনির্ধারকেরা যতক্ষণ এগুলা ভেবে সিদ্ধান্ত নেবেন ততক্ষণে নিশ্চিত দেশে আরও কিছু মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যে যারা মোটরসাইকেল কিনে ফেলেছেন আমরা কিন্তু তাদের রাতারাতি বাদ দিতে পারব না, কারণ অনেকেই প্রয়োজনে এই বাহন ব্যবহার করে আর যেহেতু এই বাহন অবৈধ নয় তাই তাদেরও অধিকার আছে দেশের সড়ক-মহাসড়ক ব্যবহার করার।
শেয়ার করুন