সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ বৃহস্পতিবার সকালে নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। তবে তাকে সমাহিত করা হবে, নাকি দেহ দান করা হবে, সে সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। পরিবারের সদস্যরা বৈঠক করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন গণস্বাস্থ্য ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন এবং শ্রদ্ধা নিবেদন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. আলতাফুন্নেসা।
বুধবার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বেলা ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে।
সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানাবেন। একই সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে সম্মান জানানো হবে। দুপুর ২টায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার নামাজে জানাযা হবে।
এরপর শুক্রবার সকাল ১০টায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ নেওয়া হবে সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জুমার নামাজের পর আরেক দফা জানাযা হবে।
গণ সংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা বুধবারই বৈঠকে বসবেন। সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে, তাকে সমাহিত করা হবে, নাকি দেহ দান করা হবে।
তাঁরা ১০ ভাইবোন, তার স্ত্রী-সন্তান আছেন। একজন বাদে তাদের সবাই ঢাকায় অবস্থান করছেন। দেহ দানের বিষয়টি সম্পূর্ণ তাদের সিদ্ধান্ত। তারা আজকের মধ্যে বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে আশা করছি। আগামীকাল জানাজার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
তবে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছোট বোন আলেয়া চৌধুরী পরে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত জানি পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য মরদেহ দান করার পক্ষে। তিনি কয়েকবার বলেছেন দেহ দান করতে। আমরা তার কথার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
বোন আলেয়া চৌধুরী ছাড়াও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইশতিয়াক আজিজ, নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. নাজিমুদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ভাসানি অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
মঙ্গলবার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ধানমণ্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে মারা যান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গত কয়েকদিন তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।
স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তার মরদেহ এখন রাখা আছে বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে।
একাত্তরে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিয়োগকারী জাফরুল্লাহর পরে বড় অবদান ছিল জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তুলে কম খরচে দরিদ্রদের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করায়ও তার অবদান স্মরণ করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শ পাওয়া জাফরুল্লাহ রাজনৈতিক অঙ্গনেও নানা ভূমিকা রেখে চলছিলেন। তবে এই সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠেছিল তার।
খুবই সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী; কোনো দলে যুক্ত না হলেও রাজনীতি সচেতন এই ব্যক্তি বলতেন- আমি মানুষের রাজনীতি করি।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে। ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দাফন হবে, না দেহ দান? পরিবারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা
এরপর উচ্চ শিক্ষা নিতে তিনি যুক্তরাজ্যে গেলেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পড়াশোনা বাদ রেখে দেশের টানে ছুটে আসেন।
লন্ডন থেকে ফিরে ভারতের আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রথমে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন জাফরুল্লাহ, পরে সেখানেই ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিবেদিত হন। তার এই বড় ভূমিকার কথা এখনও স্মরণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
স্বাধীনতার পর মেলাঘরের সেই ফিল্ড হাসপাতালকে ঢাকার ইস্কাটনে নিয়ে আসেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী, পরে গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘চল গ্রামে যাই’ এই স্লোগান নিয়ে হাসপাতালটি সাভারে স্থানান্তরিত হয়। তখন এর নামকরণ হয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। স্বাধীনতার পর নারীর ক্ষমতায়নে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রায় অর্ধেক কর্মী নেওয়া হয়েছিল নারীদের মধ্য থেকে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৭৯ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষা কমিটির ও নারী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮২ সালে প্রণীত জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে অবদান রাখেন তিনি।
১৯৭৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এশিয়ার নোবেল পুরস্কার হিসাবে পরিচিত ‘র্যামন ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কার তিনি পান ১৯৮৫ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি ইউনিভার্সিটি ২০০২ সালে তাকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ হিসেবে সম্মাননা দেয়।
শেয়ার করুন