শাহ্ জালাল (রহ) এর আধ্যাত্মিকতায় অবাক হয়েছিলেন পরিব্রাজক ইবনে বতুতা

ইসলাম ও জীবন

চতুর্দশ শতাব্দীর বিশ্বভ্রমণকারী ইবনে বতুতার ভারতবর্ষে আগমনের গল্প প্রসিদ্ধ। তবে জ্ঞানতৃষ্ণু এই পর্যটক যে সিলেট ভ্রমণ করেছিলেন তা অনেকেরই অজানা। আর সেই অজানার মধ্যেও অসাধারণ বিষয় হলো ইবনে বতুতার সঙ্গে হযরত শাহ্ জালাল (রহ) এর সাক্ষাৎ।

মরক্কোয় জন্মগ্রহণকারী আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বতুতা পরিব্রাজক হিসেবে ইবনে বতুতা নামে সারাবিশ্বে প্রসিদ্ধ। ২১ বছর বয়সে ঘর থেকে বের হবার পর ৩০ বছর ধরে তিনি বিশ্বভ্রমণ করেছেন। তারপর স্বদেশে ফিরে কবি ইবনে যোজাইয়ার সহায়তায় রচনা করেন তার বিখ্যাত ভ্রমণগ্রন্থ ‘রিহলা’।

রিহলা ১৪শ শতকের পূর্ব, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্যতম দলিল হিসেবে আজও সারাবিশ্বে সমাদৃত। আর এ গ্রন্থে ইবনে বতুতা বিভিন্ন সাম্রাজ্যের সম্রাটদের সাথে তার সাক্ষাতের বিষয় যেমন উল্লেখ করেছেন, তেমনি সবিস্তারে লিখেছেন বিভিন্ন সুফি-সাধকদের সাথে তার সাক্ষাতের বৃত্তান্ত।

ইতিহাসের এ দুই কিংবদন্তি চরিত্র—একজন আধ্যাত্মিক সাধক, অপরজন জ্ঞানতৃষ্ণু পরিব্রাজক — মুখোমুখি হন সিলেটের পবিত্র ভূমিতে। রিহলাতে এই সাক্ষাতের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা শুধু ঐতিহাসিক নয়, হযরত শাহ্ জালালের জীবন ও প্রাচীন সিলেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলও।

ইবনে বতুতা তার রিহলা গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডের বিশ নম্বর নিবন্ধে লিখেছেন, “আমি সোদকাওয়ান হতে কামরূপের পাহাড়ের দিকে রওনা দিলাম। যা সোদকাওয়ান থেকে একমাসের পথ। এই পাহাড় চীন ও তিব্বতের সাথে সংযুক্ত, যেখানে কস্তুরি মৃগ চরে বেড়ায়। এই পাহাড়ের মানুষজন দেখতে তুর্কীদের মতো। তারা খুব কর্মঠ এবং এ অঞ্চলের একজন দাস অন্য যে কোন দাসের চেয়ে দ্বিগুণ ভালো। তারা জাদুবিদ্যার জন্য বিখ্যাত। তবে এই পাহাড়ে আমার যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য এখানে বসবাসকারী এক সাধকের সাথে সাক্ষাৎ– শায়খ জালাল আল-দীন তাবরিজ।”

এই অংশের সোদকাওয়ান হচ্ছে বর্তমানের চট্টগ্রাম আর কামরূপ হচ্ছে একটি প্রাচীন রাজ্য, সিলেট যার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ইতিহাসবিদ অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি তার শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে লিখেছেন যে বর্তমানের সিলেট সেসময় সুপ্রাচীন কামরূপ রাজ্যের অধীন ছিলো। ব্রিটিশ ও ইস্ট-পাকিস্তান ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার অনুযায়ী, কামরূপ রাজ্য ভেঙে সিলেট এক নতুন রাজ্য হয় এবং পরবর্তীতে এই রাজ্য তিনভাগে বিভক্ত হয়ে জৈন্তা, গৌড় ও লাউড় রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

আর ইবনে বতুতার উল্লেখিত সাধক শেখ জালাল আল-দীন তাবরিজ হলেন হযরত শাহ্ জালাল (রহ) ইয়েমেনী যিনি সুদুর ইয়েমেন থেকে দিল্লী হয়ে তৎকালীন গৌড় রাজ্যে এসে রাজা গোবিন্দকে পরাজিত করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন।

ইবনে বতুতা লিখেছেন, “যখন আমি শায়খের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম, তখন তাঁর চারজন সঙ্গী পথিমধ্যে আমার সাথে দেখা করলেন। এই জায়গার দুরত্ব তিনি যেখানে থাকতেন সেখান থেকে দুই দিনের পথ। তারা আমাকে বললেন যে, শায়খ তার তাদের বলেছেন: ‘মাগরিবের মুসাফির তোমাদের কাছে এসেছেন। যাও এবং তাকে গ্রহণ করো।’ তারা তার আদেশ অনুসারে রওনা হয়েছিলেন। আমার আগমনের কথা আগে থেকে জানার কোন কারণ ছিল না। আমি তাদের সাথে শায়খের কাছে গেলাম এবং শায়খের গুহার বাইরের ধর্মশালায় আসলাম।”

তিনি লিখেছেন, “এই দেশের মানুষ, মুসলিম এবং বিধর্মী সকলেই ধর্মশালায় উপহার ও উপঢৌকন নিয়ে আসেন এবং ফকির (দরবেশ অর্থে) ও দর্শনার্থীরা সেসব খান। যখন আমি তাঁর (শায়খের) সামনে যাই, তখন তিনি উঠে দাঁড়ান ও আমাকে জড়িয়ে ধরেন। এবং আমার দেশ এবং আমার ভ্রমণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, যা আমি তাকে জানিয়েছিলাম।”

ইবনে বতুতা লিখেছেন যে শায়খের নির্দেশে তার সঙ্গীরা তাকে ধর্মশালায় নিয়ে যান এবং সেখানে তিনি তিনদিন আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।

 

ইবনে বতুতা আরো লিখেছেন, “যেদিন শায়খের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়, সেদিন তিনি ছাগলের লোমের তৈরি একটি ফরাজিয়া পরে ছিলেন, যা আমার খুব পছন্দ হয়। আমি মনে মনে বললাম, ‘আমি চাই শায়খ যদি আমাকে এটা উপহার দিতেন।’ আমি যখন তাঁকে বিদায় জানাতে গেলাম, তখন তিনি উঠে গুহার পাশে গেলেন, তার ফরাজিয়া খুলে আমাকে পড়িয়ে দিলেন, সাথে তার মাথা থেকে একটি টুপিও দিলেন। তারপর নিজে একটি সাধারণ পোশাক পরলেন। অন্য ফকিররা আমাকে জানান যে শায়খ এই ফরাজিয়া সাধারণত পড়তেন না, আমার আগমন উপলক্ষে পরেছিলেন।”

“তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, “মাগরিবি আমার এই ফরাজিয়াটি চাইবে। তারপর একজন বিধর্মী সুলতান এটি তার কাছ থেকে নিয়ে নিবে এবং আমাদের ভাই বোরহান আল-দীনকে দিবে। এটি মুলত তাঁর এবং তাঁর কাছেই যাবে,” লিখেছেন ইবনে বতুতা।

ইবনে বতুতা লিখেছেন যে দীর্ঘদিন পরে তিনি যখন চীনদেশের খানসা এলাকায় ভ্রমণ করছিলেন, তখন তিনি ভিড়ের মধ্যে তার সঙ্গীদের থেকে আলাদা হয়ে যান। তখন তার পরনে ছিল এই ছাগলের লোমের ফরাজিয়া। সেখান থেকে একজন উজির তাকে ধরে নিয়ে যান দেশটির সম্রাটের কাছে। এই সম্রাট ইবনে বতুতার গায়ের ফরাজিয়া খোলার নির্দেশ দিলে তিনি তা মান্য করেন এবং বিনিময়ে সম্রাট তাকে ঘোড়া ও অর্থ উপহার দেন।

ইবনে বতুতা লিখেছেন, “আমি এ ঘটনায় বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম, কিন্তু তারপর আমার মনে পড়লো যে শায়খ বলেছিলেন যে একজন বিধর্মী সম্রাট এটি আমার থেকে নিয়ে নিবেন। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম।”

 

তিনি লিখেছেন, “পরের বছর আমি চীনের খান বালিক (বেইজিং) এর সম্রাটের বাসভবনে ভ্রমণে যাই, সেখানে শায়খ বোরহান আল-দীন এর আতিথেয়তা গ্রহণ করি। আমি দেখতে পাই যে শায়খ আমার সেই ফরাজিয়াটির মতো দেখতে একটি জামা পরে আছেন। আমি অবাক হয়ে অঙ্গুলি নিদর্শন করলে তিনি আমার কাছে জানতে চান যে আমি ফরাজিয়াটি চিনতে পেরেছি কিনা। আমি তাকে জানাই যে এটি খানসার সম্রাট আমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।”

“শায়খ বোরহান বলেন, ‘আমার ভাই জালাল আল-দীন এটি আমার জন্য বানিয়েছে। সে আমাকে একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলো যে এই ফরাজিয়াটি হাতে হাতে আমার কাছে এসে পৌঁছাবে।” তারপর শায়খ আমাকে চিঠিটি দেখান, আমি চিঠি পড়ে অবাক হয়ে যাই কতটা সঠিক ছিলেন শায়খ জালাল,” লিখেছেন ইবনে বতুতা।

তিনি লিখেছেন, “শায়খ বোরহানকে আমি গল্পের আগের অংশ জানালে তিনি বলেন, ‘আমার ভাই জালাল আল-দীন সবকিছুতেই সেরা ছিল। কিন্তু সে ইতিমধ্যে আল্লাহর প্রিয় হয়েছে (ইন্তেকাল করেছেন)’।”

১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে এই ঐতিহাসিক সাক্ষাতের পরের বছরই ওফাত হয় হযরত শাহ্ জালাল (রহ) এর। ইবনে বতুতার ভ্রমণগ্রন্থ রিহলা’তে উল্লেখিত এই বিবরণ থেকে শুধু হযরত শাহ্ জালাল (রহ.)-এর ব্যক্তিত্ব কিংবা আধ্যাত্মিকতা নয়, বরং সিলেট অঞ্চলের তৎকালীন সামাজিক-ধর্মীয় প্রেক্ষাপটেরও একটি দৃশ্য। ৬৮০ বছর পরেও এ ঐতিহাসিক সাক্ষাত সিলেটের প্রাচীনত্বের ও শাহ্ জালাল (রহ) এর আধ্যাত্মিকতার  অন্যতম এক নিদর্শন হয়ে আছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *