মনিকা ইসলাম:
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) শিক্ষক প্রফেসর ড. মাসুদুর রহমানের স্ত্রী রোকসানা আক্তার ভালো নেই। তিন সন্তান নিয়ে দুঃখ-দুর্দশায় তার দিন কাটছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের স্ত্রী হয়েও কান্নাই এখন তার নিত্যসঙ্গী। মাসুদ-রোকসানা দম্পতির সন্তানেরাও পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত। তাদের শখ-আহ্লাদ পূরণ করতে পারছেন না মা। এমনকি তাদের লেখাপড়ার খরচও ঠিকমতো দিতে পারছেন না। রোকসানা দাবি করেন, পরনারী আসক্তি ড. মাসুদুর রহমানকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করেছে। বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই তিনি প্রকাশ্যে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন। সিঁড়িতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে পা ভেঙেছেন। এমনকি সন্তানদেরও তিনি সহ্য করতে পারেন না। প্রায় সময় তাদেরকে মারপিট করেন। স্ত্রী-সন্তান রেখে তিনি অন্য এক নারীর সঙ্গে সময় কাটান। বিশ^বিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ভবনেও ওই নারীর সঙ্গে তাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখা যায়। দিনের পর দিন এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে রোকসানা তার স্বামীর বিরুদ্ধে গত ১৪ মার্চ সিকৃবি রেজিস্ট্রার বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
এছাড়া গত ২৫ মার্চ তিনি সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের শাহপরাণ থানায় স্বামীর বিরুদ্ধে জিডি করেছেন। লিখিত অভিযোগ পেয়ে সিকৃবি রেজিস্ট্রার এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। অভিযুক্ত ড. মাসুদুর রহমান সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি, ভেটেরিনারি, অ্যানিমেল ও বায়েমেডিকেল সায়েন্স অনুষদের অধ্যাপক। তিনি ঢাকার সাভারের সিআরপি রোডের ডগরমুড়া এলাকার ১০০ নম্বর বাসার আমজাদ হোসেন মোল্লার ছেলে। ড. মাসুদুর বর্তমানে সিলেট কৃষি বিশ^বিদ্যালয়সংলগ্ন টিচার্স গার্ডেনে বসবাস করেন।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবরে দেওয়া লিখিত অভিযোগে রোকসানা আক্তার উল্লেখ করেছেন, একে অন্যকে পছন্দ করে ২০০৩ সালে ড. মাসুদ ও রোকসানা বিয়ে করেন। এটি ছিল রোকসানার দ্বিতীয় বিয়ে এবং আগের সংসারে রোকসানার একটি মেয়ে সন্তান ছিল। ২০০৩ সালে মাসুদুর রহমান সিলেট সরকারি ভেটেরিনারি কলেজে যোগদান করেন। তখন থেকে রোকসানা তার আগের সংসারের কন্যা সন্তানসহ স্বামীর সঙ্গে সিলেটে বসবাস করতে থাকেন। মাসুদ-রোকসানা দম্পতির ঘরে আসে আরেকটি ছেলে সন্তান। তাদের দাম্পত্য জীবনও ভালো ছিল। কিছুদিন পর মাসুদুর রহমান ফেলোশিপ পেয়ে সপরিবারে দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে যান। সেখানে ছিলেন এক বছর। দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকাকালে রোকসানা আক্তার স্বামী মাসুদের ল্যাবরেটরিতে অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। এতে তাদের সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আসে। কিন্তু ওই সময়ই মাসুদ দক্ষিণ কোরিয়ায় তার এক নারী সহকর্মীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে পরিচিতজনদের মধ্যস্থতায় বিষয়টির সমাধান হয় এবং মাসুদ আর কখনও এমন কাজ করবেন না বলে অঙ্গীকার করেন। প্রায় ৩ বছর পর মাসুদ সপরিবারে দেশে ফিরে সিকৃবিতে কাজে যোগদান করেন। তাদের সংসারে আরেকটি কন্যা সন্তানেরও জন্ম হয়। কিন্তু দেশে ফেরার পর মাসুদের চারিত্রিক স্খলন আবারও রোকসানার নজরে আসে। মাসুদ ফেসবুকে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি অনীহা-উদাসীনতা দেখান। কারণে-অকারণে তিনি রাত পর্যন্ত অফিসেই থাকেন। তার মোবাইল ফোনে একাধিক নারীর অশালীন ছবি এবং এদের অনেকের সঙ্গে ভিডিওকলে যোগাযোগের রেকর্ড দেখতে পান রোকসানা। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলেই তিনি অকথ্য ভাষায় স্ত্রীকে গালিগালাজ এবং মারপিট শুরু করেন। এমনকি সন্তানদের গায়েও হাত তুলেন। ড. মাসুদ প্রায়ই ছুটি নিয়ে ঢাকায় গিয়ে তার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করেন। সংসারের খরচ দেওয়াও বন্ধ করে দেন মাসুদ। এভাবে স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি মাসুদের অত্যাচার-নির্যাতন বাড়তেই থাকে।
লিখিত অভিযোগে রোকসানা উল্লেখ করেছেন, নিজেদের একটি ফ্ল্যাট কেনার সময় রোকসানা নিজের উপার্জিত টাকা স্বামীকে দেন এবং কথা ছিল ফ্ল্যাটের দলিলে ছেলের নামও থাকবে। কিন্তু মাসুদ সেটা করেননি। এরপর এক বছরের জন্য মাসুদ আবারও বিদেশে চলে যান। কিন্তু দেশে রেখে যাওয়া স্ত্রী-সন্তানদের ঠিকমতো খবর রাখতেন না। দেশে ফিরে মাসুদ স্ত্রী রোকসানার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দেন। ছোটখাটো বিষয়েও সহিংস হয়ে স্ত্রীকে মারধর করতে থাকেন। এসময় রোকসানা জানতে পারেন এক নারীর সঙ্গে মাসুদের অবৈধ সম্পর্ক। কিন্তু এ ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই নারী তার বন্ধু ছাড়া আর কিছু নয়।’
রোকসানা জানান, সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে তিনি স্বামীর অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেও সংসার টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তার সন্তানেরা অত্যন্ত মেধাবী। কিন্তু সেই সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ ঠিকমতো দিতে পারছেন না। মাসুদ তার সন্তানদেরও সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন। মাসে দেড় লক্ষাধিক টাকা বেতন পাওয়ার পরও ড. মাসুদ সন্তানদের টিউশন ফি, বই কেনার টাকা, জামা-কাপড় কেনার টাকা, খাবার ও সংসার খরচ দেন না। এ অবস্থায় সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন রোকসানা। এমনকি কাপড় সেলাই করে, ঘরে তৈরি আচার বিক্রি করে তিনি সংসার চালাচ্ছেন।
লিখিত অভিযোগে রোকসানা আরও উল্লেখ করেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পরে তার ছোট মেয়ে নুডুলস খেতে চাইলে তিনি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দোকানে যান। এসময় মেয়ে জানতে পারে তার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের অফিসেই অবস্থান করছেন। তখন মেয়ে বাবার কাছে যাওয়ার বায়না ধরলে তিনি মেয়েকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যান। ২নং অ্যাকাডেমিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় ড. মাসুদের কক্ষে গিয়ে দেখেন একজন নারীর সঙ্গে ড. মাসুদ ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছেন। এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই ড. মাসুদ ক্ষুব্ধ হয়ে স্ত্রীকে গালিগালাজ করে মারপিট করতে থাকেন। কেন তিনি অফিসে গেছেন এ কথা বলে- রোকসানাকে বাচ্চার সামনেই টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসেন এবং সিঁড়িতে নিয়ে কিলঘুষি মারেন মাসুদ। মাসুদের সঙ্গে থাকা নারীও রোকসানার দিকে তেড়ে আসেন। বিষয়টি একাধিক শিক্ষক, শিক্ষার্থী, নিরাপত্তা প্রহরী, গাড়িচালকও প্রত্যক্ষ করেন। এক পর্যায়ে মাসুদ তার স্ত্রী রোকসানাকে অকথ্য গালিগালাজ করে মোটরসাইকেলযোগে দ্রুত চলে যান।
রোকসানা আক্তার জানান, পরদিন ২৯ ফেব্রুয়ারি বিভাগীয় প্রধান ড. মুনিরা নুর বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য তাকে কল করেন। তিনি প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে তার স্বামী ড. মাসুদ, স্বামীর সহকর্মী ড. আতাউরসহ আরও কয়েকজন শিক্ষককে দেখতে পান। দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই ড. আতাউর তেড়ে এসে রোকসানাকে জিজ্ঞেস করেন কেন তিনি অনুমতি না নিয়ে কক্ষে ঢুকেছেন এবং রোকসানার গায়ে হাত তুলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ভবনে ডেকে নিয়ে এভাবে একজন নারীর গায়ে হাত তোলার কারণ জানতে চাইলে ড. আতাউর বাকবিতণ্ডা শুরু করেন। এ অবস্থায় মার্চের ১০ তারিখে এ ব্যাপারে আবার বৈঠক করার কথা বলে সবাই উঠে যান। কিন্তু পরবর্তীতে বিভাগীয় প্রধান আর রোকসানাকে কল করেননি।
এ অবস্থায় রোকসানা আক্তার গত ১৪ মার্চ রেজিস্ট্রার বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়ে বিচারপ্রার্থী হয়েছেন। এছাড়া ২৫ মার্চ তিনি থানায় জিডিও করেছেন।
সিকৃবিসূত্র জানায়, রোকসানা আক্তারের লিখিত অভিযোগ পেয়ে বিষয়টি তদন্তের জন্য ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে রয়েছেন- সিকৃবির ভেটেরিনারি, অ্যানিমেল ও বায়োমেডিকেল সায়েন্স অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. ছিদ্দিকুল ইসলাম, প্রফেসর ড. মোহন মিয়া, প্রফেসর ড. আবুল কাশেম, প্রফেসর ড. আনজুমান আরা ও প্রফেসর ড. মুনিরা নূর।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ড. মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাই না।’
শেয়ার করুন