কাস্টমাইজেশন বনাম ক্রেতা সন্তুষ্টি!-ড. মো. আব্দুল হামিদ

মুক্তমত

 

ছাত্রজীবনে উপস্থিত বক্তৃতায় অংশ নিতাম। লটারির মাধ্যমে বিষয় নির্ধারণ হতো। প্রতিযোগিতার নিয়ম ছিল— প্রথম টপিক পছন্দসই না হলে দ্বিতীয়টা উঠানো যাবে। তবে সেটা সুবিধাজনক না হলেও প্রথম টপিকে ফেরা যাবে না। অর্থাৎ সহজ-কঠিন যা-ই হোক, দ্বিতীয় বিষয়েই বক্তৃতা করতে হবে।

প্রথম দিকে এই অপশন থাকার বিষয়টাকে ‘সুযোগ’ ভাবতাম। কিন্তু পরে উপলব্ধি করলাম, অনেক সময়ই প্রথম টপিক তুলনামূলক সহজ থাকে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সেটাতে ফেরা যায় না। তাই বক্তৃতা করার সময়ও এটা ভেবে মন খারাপ হতো—ইশ, যদি প্রথম টপিকেই বলতাম তবে জেতার চান্স ছিল!

তাই পরবর্তী সময়ে সহজ-কঠিন যা-ই হোক, আমি প্রথম টপিকেই কথা বলতাম। এ নিয়ম অনুসরণ করায় দেখলাম, বক্তৃতার সময় পুরোপুরি মনোযোগ দেয়া যায়; অযথা আফসোস করতে হয় না।

ঠিক তেমনিভাবে আজকাল চারপাশের নানা বাস্তবতা দেখে ভাবি, অনেক বিকল্প সুযোগ থাকা আমাদের সন্তুষ্টির চেয়ে বুঝি অসন্তুষ্টির মাত্রাই বৃদ্ধি করছে। মার্কেটিংয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করেছি। সেগুলো আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করাই আজকের নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকেই হোঁচট খেয়েছেন। কারণ সাধারণত ভাবা হয়, ক্রেতা সন্তুষ্টি বাড়ানোর জন্যই প্রতিষ্ঠানগুলো কাস্টমাইজেশন করে থাকে। এক্ষেত্রে আমার ফোকাস ক্রেতা হিসেবে নিজের অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করা।

তাছাড়া মনে রাখতে হবে, কোনো ব্যবসায়ী যখন কোনো কৌশল চর্চা করে তার মানে হলো—এতে তার লাভের ব্যাপার আছে। এমনকি সেটা সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) হলেও! তাই তাদের লাভ-ক্ষতি নয়, বরং ক্রেতা হিসেবে আমাদের অবস্থান ধরতে চেষ্টা করাই মুখ্য।

আমাদের শৈশবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিকল্প অপশন থাকত না। এই যেমন—প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালে ‘কেজি স্কুল’ ছিল না। ফলে সরকারি বিদ্যালয়ে পড়া ছিল অনিবার্য। তখন আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই লেখাপড়ার জন্য হারিকেনই ছিল ভরসা।

গোসল করতাম পুকুরে। নলকূপ থেকে শুধু রান্না ও খাওয়ার পানি সংগ্রহ করা হতো। তখন মসজিদে ফ্যান ছিল না। প্রয়োজনে হাতপাখা ব্যবহার করা হতো। স্কুলে পিপাসা মেটানোর একমাত্র উৎস ছিল নলকূপের পানি। কারণ তখনো পেট বোতলের আবির্ভাব ঘটেনি।

রেডিওর অনুষ্ঠান বলতে ছিল রাজশাহী বেতার। তবে খবরসহ ঢাকা কেন্দ্রের কিছু অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হতো। টেলিভিশন দেখলে অবশ্যই বিটিভি। তাও স্বল্পসময়ের জন্য। সংবাদপত্র বলতে বুঝতাম ইত্তেফাক। কারণ তখন আমাদের এলাকায় অন্য কোনো জাতীয় পত্রিকা পাওয়া যেত না।

এলাকায় একমাত্র সিনেমা হল ছিল কাদিরাবাদ সেনানিবাসে। ফলে সেখানে যে মুভি চলত সেটাই দেখতে হতো। স্কুল মাঠে খেলা হতো প্রধানত ফুটবল। সার্বক্ষণিক একা বিনোদন পাওয়ার উপায় ছিল বইপড়া। দূরবর্তী কারো কাছে খবর পাঠানোর প্রধান অবলম্বন ছিল চিঠি লেখা।

এখনকার শিশু-কিশোরদের কাছে এমন পরিস্থিতি ‘অবিশ্বাস্য’ মনে হতে পারে। তারা ভাবতে পারে—এত সীমিত সুযোগের মধ্যে ‘মানুষ’ বাঁচতে পারে? কিন্তু আমাদের সমবয়সী বা সিনিয়রদের জিজ্ঞাসা করলে তারা হয়তো বলবেন ঠিক তার উল্টোটা!

কারণ আমাদের শৈশব মোটেই বর্ণহীন বা একঘেঁয়ে ছিল না। বরং আমরা যে মধুর শৈশব পেয়েছি তা থেকে আমাদের সন্তানরা বঞ্চিত হচ্ছে ভেবে অনেক বন্ধু-সহপাঠী আফসোস করেন! কিন্তু তেমনটা কেন মনে হচ্ছে? তারা তো অনেক বিকল্প অপশন পাচ্ছে, তাই না?

ভাবনার জায়গাটা ঠিক সেখানেই। অনেক বিকল্পের মধ্য থেকে ভোগ করলে কি মানুষের সন্তুষ্টি বাড়ে? খুব সম্ভবত না। বরং সেটা বহুক্ষেত্রে অসন্তুষ্টির মাত্রাকে তীব্র করে। যেমন ধরুন, পাহাড়ি বা দুর্গম এলাকায় ঘুরতে গিয়ে বিশ্রামের সময় এক কাপ চা পান করলেন। কেমন তৃপ্তি হবে? কখনো তা অমৃত মনে হতে পারে।

অথচ অবসর সময়ে ফাইভ স্টার হোটেলে তেমন এক কাপ চা কি অনেক বেশি তৃপ্তি দিতে সক্ষম হবে? আবার ভাবুন, বার-বি-কিউ মেনু থাকে একেবারে সীমিত। অন্যদিকে বুফে আয়োজনে থাকে শতাধিক আইটেম। কিন্তু খাওয়া শেষে কোনটার তৃপ্তি বেশিক্ষণ আমাদের মনকে আচ্ছন্ন রাখে?

কল্পনা করুন, কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় বেড়াতে গেছেন। হোস্ট স্থানীয় এক শিল্পীকে (ঘরোয়া পরিবেশে) গান শোনানোর জন্য আমন্ত্রণ করেছেন। তিনি হয়তো খালি গলায় টুং-টাং দোতারা বাজিয়ে বেশকিছু গান শোনালেন। অন্যদিকে বড় কোনো ইভেন্টে পাঁচটা ব্যান্ড, আরো দশজন শিল্পী, বহু ইনস্ট্রুমেন্ট এসেছে। সেখানেও অনুষ্ঠান উপভোগ করলেন। কোনটার প্রভাব আপনার মনে বেশি সময় ধরে থাকবে?

কিংবা ধরা যাক, বড় এক মিলনায়তনে গেছেন বিশেষ অনুষ্ঠান উপভোগ করতে। শুরুর দিকে পৌঁছেছেন, হলরুম প্রায় ফাঁকা। অনেক বাছাই করে এক সিটে বসলেন। তাতে কি খুব সন্তুষ্ট থাকতে পারবেন? হয়তো না, অনেককে দেখেছি বেশ কয়েকবার আসন পরিবর্তন করতে। তার পরও বসার জায়গাসংক্রান্ত অসন্তুষ্টি নিয়ে স্থান ত্যাগ করেন।

কিন্তু টিকিটে যদি সিট নম্বর লেখা থাকে; পরিবর্তনের কোনো সুযোগ না থাকে। তবে হয়তো আপনি নির্ধারিত সিটে বসার পরই সেটা নিয়ে আর ভাবতেন না। কারণ আপনি জানতেন কোনো বিকল্প নেই। তখন পুরো মনোযোগ থাকত অনুষ্ঠানের দিকে, তাই না?

নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে, মোবাইল ফোনে একসময় কলরেট অনেক বেশি ছিল। কার্ডের মেয়াদ ছিল অসুবিধাজনক। ফলে গ্রাহকরা তখন বেশ অসন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু এখন তো অ্যাপের মাধ্যমে অসংখ্য প্যাকেজ থেকে বাছাই করা যায়। এমনকি তারা আপনাকে মাঝেমধ্যে এক্সক্লুসিভ অফারও দেয়। তাই গ্রাহক হিসেবে আপনার সন্তুষ্টির মাত্রা অনেক বাড়ার কথা। বাস্তবে কি সেটা হয়েছে?

হয়নি বরং অনেক বিকল্পের মধ্য থেকে যেটা বেছে নিচ্ছেন সেটারও কিছু সমালোচনা করছেন। তার মানে হলো—বিকল্প সুযোগ থাকায় মানসিক শ্রম বাড়লেও প্রকৃত তৃপ্তি অধরাই রয়ে গেছে!

আসলে ভোক্তা হিসেবে আমাদের সুযোগ সীমিত থাকলে বিচার-বিশ্লেষণ কম হয়। হয়তো সে কারণে ওই বিষয়টা নিয়ে আর ভাবতে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু ভাবার সুযোগ থাকা মানেই আপনি টেনশনে পড়বেন। বিকল্পগুলোর মধ্য থেকে যেটা বেছে নেবেন, সেটারও কিছু সমস্যা দৃশ্যমান হবে। তখন আপনি ভাবতে থাকবেন, অন্যটা নিলে হয়তো এ সমস্যা হতো না!

খুব সম্ভবত সে কারণেই যারা একাধিক প্রেম করার পর বিয়ে করেন তাদের দাম্পত্য জীবন কঠিন হয়। নিজের অজান্তেই প্রতিনিয়ত জীবনসঙ্গীর নানা বৈশিষ্ট্য অন্যদের সঙ্গে তুলনা করতে থাকেন।

অন্যভাবে দেখলে, যৌথ পরিবারে অনেক সমস্যা থাকে। সেই তুলনায় একক পরিবারে তো কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা না। কারণ এখানে সবকিছু হয় নিজেদের ইচ্ছামতো, তাই না? কিন্তু একক পরিবার কালচারে সংসারগুলোয় কি সুখ বহুগুণ বেড়েছে? সাধারণত না। কেন এমনটা হচ্ছে?

শিল্পোন্নত দেশগুলোয় এমনকি আমাদের দেশের অভিজাত এলাকায় ইদানীং বহু ফ্ল্যাটে দুটো মাস্টারবেড রাখা হচ্ছে! দুজনে সারা দিন বাইরে কঠোর পরিশ্রম করে বাসায় ফিরে নিজেদের মতো থাকার সুযোগ থাকলে ভালোই হয়, তাই না?

কিন্তু এ ‘সুযোগ’ কি দীর্ঘমেয়াদে সত্যিই কল্যাণ বয়ে আনে? যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ায় প্রত্যাশিত সুখ মেলেনি। এখন দেখা যাক, প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে চূড়ান্ত সুখ মেলে কি না?

তবে এক্ষেত্রে স্মর্তব্য, লোকদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন করা খুব কার্যকর এক বিজনেস স্ট্র্যাটেজি। ইউরোপ-আমেরিকায় এটার সফল প্রয়োগ হয়েছে। আমরা বুঝে-না বুঝে সেটা অনুসরণ করছি। ফল কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

পরিবারের সবাই যখন মিলেমিশে থাকে তখন তাদের ভালো থাকার জন্য আলাদা পণ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না। কিন্তু মানুষ একা হয়ে গেলে প্রত্যেক পদক্ষেপে অন্যদের দ্রব্যসেবা কিনতে হয়। ফলে একজন আয়কারী ব্যক্তিকে একা করতে পারা বহু কোম্পানির জন্য লাভজনক! বিষয়টা বুঝতে লক্ষ করুন, সংসারে ঝামেলা হলে ফোন খরচ, গাড়ি ভাড়া, বাইরে খাওয়াসহ কত্ত রকম খরচ বাড়ে।

শুরুতে বলেছিলাম, আমাদের সময় শুধু বিটিভি ছিল। এখন শতাধিক টিভি চ্যানেল হয়েছে। কিন্তু তৃপ্তি কি সেই তুলনায় বেড়েছে? তখন কালেভদ্রে সিনেমা দেখার সুযোগ হতো। এখন চাইলে দিনে কয়েকটা দেখা যায়। কিন্তু তৃপ্তি তখনকার তুলনায় কি সত্যিই বেড়েছে? নিয়মিত এসির সেবা পেতে অভ্যস্তদের মাত্র কয়েক মিনিট বিদ্যুৎ না থাকলে দমবন্ধ হয়ে আসে। দীর্ঘক্ষণ ভালো থাকার বিপরীতে ক্ষণিকের খারাপ থাকা বড় হয়ে ধরা দেয়।

হয়তো সে কারণেই আজকাল অর্থ-বিত্ত, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ার পরও শহরে অসুখী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। কারণ আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। এরই মধ্যে যা যা অর্জন হয়েছে সেগুলো অবজ্ঞা করছি। অন্যদিকে সামান্য ঘাটতি অনেক বড় বলে গণ্য হচ্ছে।

মার্কেটিং বলে, আপনার সন্তুষ্টির মাত্রা কোনো কিছু থাকা বা না থাকার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে না। বরং যা প্রত্যাশা করেছিলেন বাস্তবে তা পেলেন কিনা সেটাই নির্ধারণ করে সন্তুষ্টির মাত্রা। হয়তো সে কারণেই একজন বস্তিবাসীও মাঝেমধ্যে নিজেকে চরম সুখী ভাবে। আবার শীর্ষ ধনী ব্যক্তিটিও মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে পড়েন।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা একেকটা পণ্য কিনি আর ভাবি সেটা পেলেই বুঝি চূড়ান্ত সুখ লাভ হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয় না। অর্জনের তৃপ্তি দ্রুতই ফিকে হয়ে যায়। জীবনে চলার পথ বন্ধুর। ঠিক তেমনিভাবে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির মাত্রাও ওঠানামা করবে।

শুধু কাস্টমাইজড কেন, দুনিয়ার কোনো দ্রব্য বা সেবার বিনিময়েই সর্বদা তৃপ্ত থাকা সম্ভব নয়। তাই সন্তুষ্টি নিজের মনোজগতে খুঁজতে হবে, কাঙ্ক্ষিত পণ্যে নয়।

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘সুখের অসুখ’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ১৩ জুন ২০২৩। Proto credit: Marketing Tech Stack.

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *