নিজেকে অপরিহার্য ভাবা : কল্পনা বনাম বাস্তবতা ড. মো. আব্দুল হামিদ

মুক্তমত

বড় অস্থির এক সময়ে বাস করছি আমরা। ব্যক্তি থেকে বিশ্ব পরিসরে এ অস্থিরতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া এর আওতাও বেশ ব্যাপক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব দিকেই যেন মহাপ্রলয়ের সুর বাজছে।

আমরা সবাই মিলে ধ্বংসের ক্ষণকে ত্বরান্বিত করতে যেন উদগ্রীব হয়ে উঠেছি। ফলে করোনা মহামারী থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে থাকাবস্থায় একের পর এক আসছে অভিঘাত। সামনে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও দেখতে হবে। পারমাণবিক বোমার মালিকদের এমন দ্বন্দ্বের ফল দেখার জন্য আমরা টিকে থাকব কিনা তাও অনিশ্চিত।

অন্যদিকে, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জীবনযাপনের অন্যান্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি এবং নানা অস্থিরতা প্রতিনিয়ত শঙ্কা বাড়াচ্ছে। সামনের দিনগুলো ঠিক কীভাবে চলবে কিংবা কী হতে যাচ্ছে, তা ভেবে সবার উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। এখন কথা হলো—চাইলেই কি আমরা এ সংকটগুলো দূর করতে পারি? কিংবা এ সমস্যাগুলো থেকে নিস্তার পাওয়ার ক্ষমতা কি আমাদের হাতে রয়েছে?

না, সামষ্টিক বিষয়গুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলে সেগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করা ছাড়া উপায় কী? তবে অন্তত একটা দিক আমাদের হাতের মধ্যে রয়েছে। সেই দিকে আলোকপাত করাই আজকের নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

ছোটবেলা ভাবতাম আমাদের চেয়ে বয়সে বড়রা কতই না স্বাধীন! অর্থাৎ আমরা ছোট হওয়ায় সব সময় তাদের কাছ থেকে নানা আদেশ-নিষেধ ও বাধা আসত। ফলে নিজেদের খুব অসহায় (ক্ষেত্রবিশেষে পরাধীন) মনে হতো।

অথচ বড়দের কাজকর্মের ক্ষেত্রে তেমন কোনো খবরদারি চোখে পড়ত না। ফলে ভাবতাম আমরাও যখন বড় হব তখন আর কোনো শৃঙ্খল থাকবে না। নিজের মতো করে স্বাধীনতার সুখ উপভোগ করা যাবে। প্রিয় পাঠক, আপনার কী মনে হয়—বড় হওয়ার পরে সত্যিই কি আমরা অনেক বেশি স্বাধীন হয়েছি?

শৈশব ও কৈশোরে আমাদের শেখানো হয়েছে পড়ালেখায় ভালো করাই জীবনের চরম সফলতা। তার পরে ভালো চাকরি পাওয়া বা সম্মানজনক পেশায় যাওয়া। এর পরে মনে হয়েছে, আর্থিক সমৃদ্ধিই বুঝি আমাদের সাফল্যকে পূর্ণতা দেবে। ফলে জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রত্যাশিত সফলতা লাভের জন্য ছুটছি।

একেকটা (রেজাল্ট, চাকরি ও অর্থসম্পদ) বিষয়ে সফলতা লাভের প্রাক্কালে মনে হয়—প্রত্যাশিত সুখ-শান্তি এই বুঝি হাতের নাগালে চলে এলো! অর্জনের কষ্ট শেষ, এবার তা উপভোগের পালা। কিন্তু বাস্তবে সেটা কী সত্যিই হয়ে থাকে?

আপনার চারপাশের তথাকথিত সফল মানুষগুলোর পেরেশানি দেখে কী মনে হয়—তারা সুখের সাগরে ভাসছে?

না, তেমনটা হয় না। বরং তার উল্টোচিত্রই প্রায়ই দেখা যায়। যে ব্যক্তি যত বেশি ‘সফলতা’ লাভ করেছে তার সংকট যেন তত বেশি! একজন বস্তিবাসী বা দিনমজুরের সঙ্গে আলাপে সাধারণত একটা সমস্যার কথা বলে। সেটা হলো—আজকের দিনটি চলার মতো পয়সা কোথায় পাবে?

অন্যদিকে একজন ধনী লোকের সঙ্গে একান্ত আলাপে অন্তহীন সমস্যার কথা শোনা যায়। পাঁচতলা বাড়ি, দামি গাড়ি, সন্তানদের স্বপ্নের দেশে অবস্থান, ব্যবসায় আশাতীত মুনাফা কোনো কিছুই তাকে চূড়ান্ত সন্তুষ্ট করতে পারে না।

তাদের যেসব সম্পদ আছে (বা এরই মধ্যে অর্জন হয়েছে) সেগুলো থাকার সন্তুষ্টি বা তৃপ্তি নেই। বরং সেই সম্পদগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো প্রায়ই তাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

‘সুখের অসুখ’ বইটি লেখার আগে আমি নিবিড়ভাবে অসংখ্য মানুষকে পর্যবেক্ষণ করেছি। তখন মনে হয়েছে, যে যত বেশি সফলতা পেয়েছে সে তত বড় ‘রাখাল’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বেয়াড়া গরু-ছাগল চরাতে গিয়ে একজন রাখাল যেমন সবসময় তাদের নির্দিষ্ট এলাকায় রাখতে তটস্থ থাকে, তারাও তেমনটা করছে।

অথচ ওই অর্জনগুলোর মাধ্যমে তার নিজের ভোগের পরিমাণ যে আহামরি মাত্রায় বেড়েছে, তেমনটা বলা যাচ্ছে না। বাহ্যিকভাবে যাদের অতিসফল বলে মনে হয়, তাদের ভেতরে চরম অস্থিরতা কাজ করছে। নিজেদের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়ে সেগুলো তারা কারো সঙ্গে শেয়ারও করতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত অসহ্য যন্ত্রণা ও কষ্ট তারা বয়ে বেড়াচ্ছে।

কেন এমনটা হয়? অর্জনের পাশাপাশি সেগুলোর ভোগ, বিশ্রাম কিংবা নিজেকে সময় দেয়ার মতো ফুরসত তারা কেন পান না?

কারণ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র সব জায়গায় তারা নিজেকে অপরিহার্য ভাবতে শুরু করেন। তিনি ছাড়া অন্যেরা কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারবে না, অন্যেরা সেগুলো নষ্ট করে ফেলবে কিংবা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হবে না ইত্যাদি ভাবনা তাদের বিচলিত করে। ফলে একের পর এক নিজের দায়িত্বের আওতা বাড়াতে থাকেন।

বড় লক্ষ্য স্থির করে ভাবেন, আরেকটু কষ্ট করলেই সেটা তিনি সম্পন্ন করতে পারবেন। এভাবে তাদের বোঝা একপর্যায়ে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তাদের মানসিক কষ্ট বা সমস্যার কথাগুলো কেউ শুনতে চায় না। সবাই তার কাছে ‘পারফরম্যান্স’ চায়। তিনিও অতিআত্মবিশ্বাসী হয়ে একের পর এক দায়িত্ব নিতে থাকেন।

এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো—অন্যরা যতটা দায়িত্ব তাকে দেয় তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি নিজে কাঁধে তুলে নেন। আরেকটু সফল হওয়া, আরেকটা বড় লক্ষ্য অর্জন করার নেশা তাদের পেয়ে বসে। কিন্তু কোনো কারণে তাতে ছেদ ঘটলে তখন তাদের হুঁশ হয়।

বড় কোন দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, কেলেঙ্কারি বা পদচ্যুতির পরে বুঝতে পারেন, সেই মানুষটা বড় একা। এতদিন যারা চারপাশে ঘুরঘুর করত আজ তারা কাছে এসে বসার সময় পায় না। এমনকি সেভাবে পাত্তাও দেয় না। কিন্তু তখন অনেক বেশি দেরি হয়ে যায়।

অনেকেরই শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সময় এবং সামর্থ্য থাকে না। ফলে চরম সফল মানুষটিও হতাশায় ভুগতে থাকে। সারা জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমকে নিতান্তই পণ্ডশ্রম বলে মনে হয়। এমনকি নিজের দিকে তাকানোর সময় না পাওয়া মানুষটি নিজেকে হতভাগা ভাবতে শুরু করে।

তাই আপনার পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্রে নিজেকে অপরিহার্য ভাবা বাদ দিন। আজ ভাবছেন আপনি না থাকলে কোনো কিছুই ঠিকভাবে চলবে না। আসলে এ ধারণাটি ঠিক নয়। পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়।

এখন থেকে ৫০-৬০ বছর আগে আপনি ছিলেন না। তখন আপনার অনুপস্থিতিতে পৃথিবী কি তার গতি হারিয়েছিল? আপনি না থাকায় কি পৃথিবীর কোনো মহৎ কাজ আটকে ছিল? না, সবই চলেছে তার স্বাভাবিক গতিতে।

আবার এখন থেকে একটা সময় পরে আপনি থাকবেন না। তাতে এ মহাবিশ্বের আদৌ কোনো ছন্দপতন ঘটবে না। তাই নিজেকে সবকিছুর জন্য অপরিহার্য ভেবে বহন ক্ষমতার চেয়ে বেশি বোঝা নেবেন না। এতে শুধু নিজেরই ক্ষতি হয়।

চারপাশে অত্যন্ত গতিশীল, সফল মানুষগুলোকে আকস্মিক অসুস্থতায় নিশ্চল হয়ে যেতে দেখছি। অনেকে দুনিয়া ছেড়েই চলে যাচ্ছেন। তাতে সেই পরিবার, সমাজ বা প্রতিষ্ঠানের আহামরি কোনো পরিবর্তন হয় না। বরং বহু ক্ষেত্রে উত্তরাধিকাররা আরো ভালোভাবে সেগুলো চালাচ্ছেন।

আজকাল মানুষের শারীরিক ও মানসিক অশান্তির অন্যতম কারণ হলো—অনেক বড় বড় লক্ষ্য স্থির করা আর সেগুলো অর্জনে নিরন্তর ছুটে চলা। তাই একটু থামুন। নিজেকে সময় দিন। সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে পৃথিবীতে আগমনের পরও শুধু স্ব-আরোপিত শৃঙ্খলে সারাটা জীবন আবদ্ধ থাকার মানে হয় না।

অনেকে ভাবতে পারেন, তাহলে আমি কি কর্মব্যস্ত থাকাকে অনুৎসাহিত করছি। অবশ্যই না। বরং সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মেধা ও যোগ্যতার সর্বোত্তম ব্যবহারে আমাদের সর্বদা সচেষ্ট থাকা উচিত। কিন্তু সফল হওয়ার দৌড়ে নাম লেখানোর পরে আমরা অনেকেই এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়ি, নিজের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার দিকে খেয়াল করার সময়টুকুও বের করতে পারি না। মননশীলতার উত্কর্ষ সাধনে কিছুটা সময় বিনিয়োগ করতে পারি না। ফলে কোনো কারণে আকস্মিক সে দৌড় থেমে গেলে তখন নিজেকে বড় একা ও হতভাগা মনে হয়।

জীবনে তেমন ক্ষণ আসার আগেই নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে কিছু কাজের দায়িত্ব অন্যদের দেয়া উচিত। আপনার সন্তান যে কাজ করতে গেলে ভুল করবে বা ঠকে যাবে ভাবছেন, কাল আপনার অনুপস্থিতিতে কিন্তু তাকেই সেটা করতে হবে। তখন তাকে ঠকে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে কে?

তাই আপনি ছাড়াও এ মহাবিশ্বের গতি সামান্য হেরফের হবে না, কোনো কিছুই আটকে থাকবে না। শুধু আপনি দৃশ্যপটে থাকবেন না—এটাই বাস্তবতা। তাই নিজেই মাঝেমধ্যে নিজেকে ছুটি দিন।

মানসিক ও আত্মিক পরিতৃপ্তির উপায় খুঁজে বের করুন। নিজের কর্ম ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করুন। না হলে সাধ্যাতীত জোরে দৌড়াতে গিয়ে আকস্মিক পেশিতে টান লেগে মাঠেই লুটিয়ে পড়তে পারেন।

তখন শতচেষ্টা করেও আপনাকে আর প্রতিযোগিতায় রাখা যাবে না। সিস্টেম সেটা বরদাশত করবে না। তাই সময় থাকতে সচেতন হোন।

ড. মো. আব্দুল হামিদ : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক। উৎস : বণিকবার্তা, ০৯ আগস্ট ২০২২।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *