অ্যাথলিটদের মধ্য থেকে বিশ্ব এ পর্যন্ত তিনজন বিলিয়নেয়ার পেয়েছে। তাদের অন্যতম হলেন মাইকেল জর্ডান। গোটা দুনিয়ার বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের কাছে তিনি আদর্শ। অথচ এ মানুষটির ক্যারিয়ারের সূচনা মোটেই ইতিবাচক ছিল না। বলা হয়েছিল তার উচ্চতা ওই খেলায় সফল হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়!
ফলে খ্যাতিমান কোচরা তাকে দলে নেয়নি। এ প্রত্যাখ্যানে তিনি হতোদ্যম হননি বরং সেটাকে শক্তিতে পরিণত করেছেন। সেটা কেমন? গুগলকে জিজ্ঞাসা করুন— সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের নাম কী, জবাব পেয়ে যাবেন।
বিশ্বে ধনীদের তালিকার ওপরের দিকে থাকা জেফ বেজোস ১৯৯৫ সালে তার বিজনেস আইডিয়া নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছিলেন। সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের অনেকেই সবিস্ময়ে জানতে চেয়েছিল—ইন্টারনেট জিনিসটা কী? বর্তমানে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলারের মালিককে প্রাথমিক ফান্ড জোগাড় করতে অন্তত ৬০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিজনেস প্ল্যান উপস্থাপন করতে হয়েছিল।
একপর্যায়ে ২২ জন সম্মত হয়েছিল। তারাও সবাই মিলে দিয়েছিল মাত্র ‘১ মিলিয়ন’ ডলার! সেদিন তিনি প্রত্যাখ্যানে ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলে অ্যামাজনের ধারণাটি অংকুরেই বিনষ্ট হতো, তাই না?
প্রিয় পাঠক, আপনি জীবনে মোট কতবার ‘প্রত্যাখ্যান’-এর সম্মুখীন হয়েছেন? সেটা গুনে বলা মুশকিল, তাই তো? ঠিক আছে। এবার তাহলে বলুন, জীবনে সর্বপ্রথম কোন ঘটনায় নিজেকে প্রত্যাখ্যাত মনে হয়েছিল?
খুব সম্ভবত কিশোর বয়সে বিশেষ কেউ এমন অভিজ্ঞতা দিয়েছিল, তাই না? পরবর্তীকালে প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কত রকমের প্রত্যাখ্যান যে কপালে জুটেছে তা হয়তো আপনি ছাড়া দুনিয়ার কেউ জানে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো—প্রত্যাখ্যান কি শুধুই হতাশা বয়ে আনে?
এক কথায় বলা মুশকিল। প্রত্যাখ্যান সইতে না পেরে অনেকে পড়ালেখা ছাড়ে, কেউবা হয় মাদকাসক্ত। এমনকি আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। সেদিক থেকে বিষয়টি মারাত্মক ক্ষতিকর। তবে তার বিপরীত চিত্রও রয়েছে। আপনি নিজেও হয়তো তার প্রমাণ। কেন সেটা মনে হলো? আপনি এখনো পড়ছেন তার মানে আপনি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় আছেন।
আসলে ‘প্রত্যাখ্যান’ বিষয়টাকে আমরা কীভাবে দেখি, উপলব্ধি করি ও প্রতিক্রিয়া দেখাই তার ওপর নির্ভর করে ফলাফল। এটা যেমন ধ্বংস বয়ে আনতে পারে, ঠিক তেমনিভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ভিত্তি হিসেবেও ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্বজোড়া খ্যাতি পাওয়া কয়েকজন ব্যক্তিকে বাছাই করুন। দেখবেন তাদের প্রায় প্রত্যেকের জীবনে রয়েছে তীব্র প্রত্যাখ্যানের অভিজ্ঞতা। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রীড়া-বিনোদন সব ক্ষেত্রেই এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
জীবনে প্রথম চেষ্টায় হয়তো তারা সংশ্লিষ্টদের কাছে পাত্তাই পায়নি। এমনকি ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু তারা নিরলসভাবে চেষ্টা করে গেছেন। একসময় সফলতা তাদের হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে। তখন হয়তো তাদের সমালোচকরাও হয়েছেন প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বর্তমানে জে. কে. রাওলিং সাহিত্যকর্মের বিশ্বময় বাণিজ্যিক সফলতা আকাশচুম্বী। অথচ তার সেরা সৃষ্টিকর্ম (হ্যারিপটার সিরিজ) নিয়ে একসময় প্রকাশকদের প্রত্যাখ্যানের শিকার হয়েছেন। কেউ সেটা ছাপার যোগ্য মনে করেনি। ১২ জন প্রকাশকের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও তিনি হাল ছাড়েননি। সেটা ছাপা হওয়ার পর এমন সফলতা এসেছে যার দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল!
এমন ঘটনা আমাদের কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাকের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। তিনি ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র পাণ্ডুলিপি নিয়ে কলকাতায় অসংখ্য প্রকাশকের দ্বারস্থ হয়েছেন। কেউ পড়েও দেখেনি, অবজ্ঞার সুরে কথা বলেছেন। অথচ সেটা প্রকাশের পর পান সর্বমহলের ভূয়সী প্রশংসা।
এমনকি সেই উপন্যাসের ভিত্তিতে সিনেমা নির্মিত হলে তা সার্ক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সেরা চলচ্চিত্র’-এর মর্যাদা পায়! সেই তুলনায় আপনার প্রত্যাখ্যানের অভিজ্ঞতা কি আরো পীড়াদায়ক?
আইনস্টাইনের কথাই ধরা যাক, চার বছর বয়স পর্যন্ত তিনি স্বাভাবিক কথা বলতে পারতেন না। সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে ‘বোকা’ বলে পরিচিত ছিলেন। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাকে অলস ও অন্যমনস্ক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল!
তার কিছু প্রশ্নের মাথামুণ্ডু থাকত না বলে তাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করত। পরবর্তীকালে নিশ্চয়ই সেই শিক্ষকরা গর্ব করে বলতেন, আইনস্টাইন আমাদের ছাত্র ছিল!
আবার ইলোন মাস্কের কথাই ধরুন। তার ক্যারিয়ার মানেই টেসলা বা স্পেস-এক্সের সফলতা নয়। নব্বইয়ের দশকে তিনি নানা ক্রিয়েটিভ আইডিয়া নিয়ে অনেকের কাছে যান। কেউ সেগুলোয় কান দেয়নি। এমনকি প্রত্যাশিত ফল অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় একসময় পেপালের প্রধান নির্বাহীর পদ হারান!
এক রাশিয়ান মহাকাশযান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তার কাছে রকেট বিক্রিতে অসম্মত হয়। কারণ তার বিজনেস আইডিয়া তাদের কাছে বাস্তবসম্মত মনে হয়নি! কিন্তু প্রত্যাখ্যান তাকে দমাতে পারেনি।
বরং প্রত্যেকবার নিজ আইডিয়ার সঙ্গে ভ্যালু অ্যাড করে তা বিনিয়োগকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে সচেষ্ট থেকেছেন। এখন তো তার অকল্পনীয় সব প্রজেক্টেও বিনিয়োগকারীর অভাব হয় না!
ওয়ারেন বাফেটের জীবন সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি তার পুরোটাই সফলতার গল্প। ব্যাপারটা কি সত্যিই তেমন? না, বরং তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার জীবনে মোড় পরিবর্তনকারী সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ছিল প্রত্যাখ্যানের! তিনি তরুণ বয়সে হার্ভার্ডে পড়ার জন্য মরিয়া ছিলেন।
কিন্তু সেখানে মাত্র ১০ মিনিটের এক সাক্ষাৎকার নিয়ে তাকে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়। এটা তাকে ভীষণ পীড়া দেয়। নিজের যোগ্যতা প্রমাণে কঠোর ও নিরলস পরিশ্রম করতে থাকেন। এখন তো তিনি রীতিমতো জীবন্ত কিংবদন্তি!
ভাবুন, একজন কার্টুনিস্ট তরুণ বয়সে সংবাদপত্রের চাকরি হারান এ অপবাদে যে তিনি যথেষ্ট ক্রিয়েটিভ নন। এমনকি তার মিকিমাউস কার্টুন ম্যাগাজিনগুলো ছাপাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল এই বলে যে অনেকে ভয় পাবে! একজন মানুষের মনোবলে চিড় ধরার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।
কিন্তু ওয়াল্ট ডিজনি এ সব প্রত্যাখ্যানকে নিজের ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠার অবলম্বন হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। তাই তো আমরা পেয়েছি ‘দি ওয়ার্ল্ড ডিজনি কোম্পানি’র মতো বিশাল উদ্যোগ। এর আওতা কতটা ব্যাপক তা বোঝার জন্য এ তথ্যটুকু যথেষ্ট যে ২০২২-২৪ সালে তারা সামাজিক কল্যাণ (সিএসআর) খাতে ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে!
চীনের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জ্যাক মার জীবনের প্রথম পর্যায় ছিল প্রত্যাখ্যানে ভরা। হার্ভার্ডে পড়ার জন্য ১০ বার আবেদন করেছেন, প্রত্যেকবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন!
কেএফসি চীনে ব্যবসা শুরুর প্রাক্কালে বাছাইকৃত ২৪ জনের মধ্যে ২৩ জনেরই চাকরি হয়, জ্যাক মা ছাড়া! তার ভাষ্যমতে, জীবনে তিনি ৩০ বার উল্লেখযোগ্য প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হয়েছেন। সবাই ভাবে সফলতা হলো প্রত্যাখ্যানের বিপরীত শব্দ। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেছেন, প্রত্যাখ্যান আসলে সফলতারই অংশ।
বিশ্বখ্যাত জিলেট ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবসা শুরুর পর প্রথম বছর মাত্র ৫১ রেজর ও ১৬৮ ব্লেড বিক্রি হয়েছিল! তার সেফটি রেজরের আইডিয়া হালে পানি পায়নি।
প্রথম তিন বছর বিনিয়োগকারী, মধ্যস্থ কারবারি, ক্রেতা সবাই তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অথচ সেই কোম্পানি ১২০ বছর ধরে গোটা দুনিয়ায় দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করে যাচ্ছে; যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে নিরাপদ শেভিং রেজর ও ব্লেডের মার্কেট লিডার!
এমন অজস্র উদাহরণ দেয়া যায়। কিন্তু মূলভাব উপলব্ধির জন্য উল্লিখিত ঘটনাগুলোই যথেষ্ট। আমরা শৈশব থেকে প্রত্যাখ্যানকে ভয় পাই। পরিবার, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র সর্বত্র তেমন এক আবহ বজায় রাখা হয়। ফলে যেকোনো মূল্যে প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হওয়া এড়াতে চাই।
প্রয়োজনে সে পথে হাঁটব না তবুও আমরা প্রত্যাখ্যাত হতে চাই না! অথচ আইনস্টাইন বলেছেন, একজন ব্যক্তি জীবনে ভুল করেনি তার মানে সে নতুন কিছু করার চেষ্টাই করেনি!
তাহলে প্রত্যাখ্যানকে কীভাবে হ্যান্ডল করা উচিত? প্রথম কথা হলো, এটা জীবনেরই অংশ। তাই এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়া শিখতে হবে। অস্বীকার করা, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো কিংবা পাশ কাটাতে চেষ্টা করা কোনো সমাধান নয়। বরং ইলোন মাস্কের মতো প্রত্যাখ্যান থেকে শিক্ষাটা নিতে হবে। শুধু ইমোশনাল না হয়ে নিজের ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স তীক্ষ্ণ করতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রত্যাখ্যানের ঘটনাগুলোকে পারসোনালি নেয়া যাবে না। যেমন সেদিন এক জায়গায় যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলাম। যাকেই বলি, যাবে না। কেউ কেউ জবাব পর্যন্ত দিচ্ছিল না। গন্তব্য শুনেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। পরপর কয়েকজন এমন করায় মেজাজ খারাপ হওয়ার কথা।
কিন্তু বিক্রয়সংক্রান্ত কিছু পড়াশোনা থাকায় আমার সেটা হলো না। বরং যে রিকশাওয়ালাই সামনে পড়ছে তাকে হাসিমুখে আমার গন্তব্যে যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছি। এমনটা দেখে জাইন সবিস্ময়ে জানতে চাইল, তাদের এমন প্রত্যাখ্যানে আমি মজা পাচ্ছি কিনা?
তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, এ পর্যন্ত কয়জন রিকশাওয়ালা আমাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে? সে হিসাব করে বলল, সাতজন। এবার বললাম, চলো এটাকে আমরা ‘ফান‘ হিসেবে নিই। দেখা যাক, কততম চেষ্টায় সফল হই? সেদিন ১৩তম রিকশাওয়ালা আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়!
রিকশায় বসে ছেলে জানতে চাইল—এমন আচরণের কারণ কী? জবাবে বললাম, আসলে যারা আমাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে তাদের কোনো দোষ নেই। আমরা যেখানে যেতে চাই, তারা সেখানে যেতে চায় না।
ফলে তারা প্রত্যাখ্যান করবে সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? সে বলল, কিন্তু আমার তো রাগ হচ্ছিল। তারা রিকশা চালাবে অথচ আমাদের নিয়ে যাবে না কেন?
তখন বললাম, তোমার রাগ হচ্ছে কারণ তুমি বিষয়টিকে পারসোনালি নিচ্ছ। কোনো রিকশাওয়ালাই ব্যক্তি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেনি। তারা আমাদের চেনেও না, আমাদের সঙ্গে কোনো শত্রুতাও নেই। তারা ফিরিয়ে দিয়েছে আমাদের প্রস্তাব! ফলে এটা নিয়ে রাগ-গোস্বা করা কিংবা পরের রিকশাওয়ালার সঙ্গে ধমকের সুরে কথা বলা কোনো কল্যাণ করবে না।
তাই লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে আপাতত প্রত্যাখ্যান হজম করতে হবে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ জগতে সত্যিকারের বড় কিছু যারা অর্জন করেছে তাদের প্রত্যেকেরই এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।
ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘ফেইলিওর ইন সেলস’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩।