یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡخَمۡرُ وَ الۡمَیۡسِرُ وَ الۡاَنۡصَابُ وَ الۡاَزۡلَامُ رِجۡسٌ مِّنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ فَاجۡتَنِبُوۡهُ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ
হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া,
মূর্তিপূজার বেদী এবং ভাগ্য নির্ধারক তীর ঘৃণিত শয়তানী কাজ, তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সাফল্যমন্ডিত হতে পারো। [৫. সূরা মায়িদাহ: ৯০]
মাদকের মরণছোবল দুনিয়ার বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মাদকাসক্ত লোকেরা নিজেরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পাশাপাশি জাতিকেও হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। সুন্দর পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। প্রিয় দেশেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত এই সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। যা নিয়ে সবাই রীতিমতো টেনশনে। তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠার যেন শেষ নেই। পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য বিষয়টি খুবই মর্মবেদনার।
মাদক মানে যা সেবন করলে নেশা হয় এমন। মত্ততা বা নেশা সৃষ্টি করে এমন জিনিস। আর মাদক দ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং দ্রব্যের উপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে ব্যক্তির এই অবস্থাকে বলে মাদকাসক্তি। ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি)-এর মন্তব্য: মাদক গ্রহণের ফলে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া গেলেও এই ক্ষণস্থায়ী স্বস্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর ফাঁদ। ফাঁদে একবার জড়ালে স্বাস্থ্যহানি ঘটে, সৃজনীশক্তি শেষ হয়ে যায়। ‘স্বাস্থ্যহানি’ বলতে কেবল দৈহিক স্বাস্থ্যের কথা বলা হচ্ছে না। দেহের পাশাপাশি বিশৃঙ্খল ও বিধ্বস্ত হয়ে যায় মনের স্বাস্থ্য, পুড়ে যায় আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক চিত্রে নেমে আসে দুর্যোগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপ থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে ১৮ বছরের ওপরে শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষ মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৫ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। অথচ এই সকল তরুণ ও যুবকরাই নানা ধরনের মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। না বুঝেই অনেক তরুণ বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, মাদক সেবনের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৮০ লাখ মানুষ এবং বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ মারা যায়। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তবে এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৭০ লাখের মত মাদকাসক্ত আছে। এর মধ্যে ৭৪ শতাংশ হলো ছেলে আর ২৬ শতাংশ মেয়ে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে৷ আর এসব মাদকের মধ্যে রয়েছে: ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, প্যাথেডিন, বুপ্রেনরফিন (টি.ডি. জেসিক ইঞ্জেকশন), ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন (বনোজেসিক ইঞ্জেকশন), মরফিন, আইচ পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন৷ তবে বাংলাদেশের মাদকসেবীরা সেবন করে ৬ থেকে ১০ ধরনের মাদক৷ সবচেয়ে ভয়াবহতা ইয়াবাকে ঘিরে৷
মাদকাসক্তির দিকে ধাবিত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো: মস্তিষ্কে এক বিশেষ ধরনের প্রোটিনের পরিমাণ কম থাকা এবং মলিকিউলার মেকানিজমের ফলে মাদকাসক্তি দেখা যায়। যা একটি সমীক্ষায় জানা গেছে। মাদকাসক্তদের মস্তিষ্কে GAT-3 প্রোটিনের পরিমাণ কম থাকায় তারা তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মাদকাসক্তির বড় কারণ হলো- মাদকের সহজলভ্যতা, মাদকের প্রতি তরুণ প্রজন্মের কৌতূহল ও নিছক মজা করার প্রবণতা, মাদকের কুফল সম্পর্কে প্রকৃত ধারণার অভাব, মাদক বিষয়ে ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে বন্ধুদের চাপ, পারিপার্শ্বিক কারণ, ব্যর্থতা। এমনকি মাদক নিয়ে স্মার্ট হওয়ার প্রবণতাও অনেককে ঠেলে দেয় মাদকের জগতে।
মাদকের ভয়াবহতা থেকে মাদকাসক্তদের ফিরিয়ে আনা এবং তাদেরকে হেফাযতে রাখা, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের নৈতিক ও মৌলিক দায়িত্ব। যারা মানুষকে হেদায়াতের আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত করতে চান। সত্য ও সুন্দরের পথে আহবান করেন। মানবতার কল্যাণে সদা নিবেদিত। সেইসব মুফাসসিরে কুরআনদের দায়িত্ব কোনো অংশেই কম নয়; বরং অত্যধিক। যেহেতু তাদের সুন্দর কথা ও চারিত্রিক মাধুর্য দেখে লক্ষ কোটি মানুষ আলোকিত পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। তাই এক্ষেত্রে তাদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের দায়িত্ব: মুসলিম দাবীদার অথচ মাদকের মতো মারাত্মক হারাম যারা গ্রহণ করছেন, তাদেরকে কুরআন ও হাদীসের আলোকে সতর্ক করা। মাদকের কুফল ও পরিণতি বর্ণনা করা।
রাসুলুল্লাহ (সা.) মদ সংশ্লিষ্ট দশ শ্রেণির লোককে লা‘নত তথা অভিসম্পাত করেছেন। হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তারা বলেন:
«لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ رسول الله صلى الله عليه وسلم فِيْ الْـخَمْرِ عَشْرَةً: عَاصِرَهَا، وَمُعْتَصِرَهَا، وَشَارِبَهَا، وَحَامِلَهَا، وَالْـمَحْمُوْلَةَ إِلَيْهِ، وَسَاقِيَهَا، وَبَائِعَهَا، وَآكِلَ ثَمَنِهَا، وَالْـمُشْتَرِيَ لَهَا، وَالْـمُشْتَرَاةَ لَهُ، وَفِيْ رِوَايَةٍ: لُعِنَتِ الْـخَمْرُ بِعَيْنِهَا، وَفِي رِوَايَةٍ: لَعَنَ اللهُ الْـخَمْرَ وَشَارِبَهَا»
“রাসুলুল্লাহ (সা.) মদের ব্যাপারে দশজন ব্যক্তিকে লা‘নত বা অভিসম্পাত করেন: যে মদ বানায়, যে মূল কারিগর, যে পান করে, বহনকারী, যার নিকট বহন করে নেওয়া হয়, যে অন্যকে পান করায়, বিক্রেতা, যে লাভ খায়, খরিদদার এবং যার জন্য খরিদ করা হয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, সরাসরি মদকেই অভিসম্পাত করা হয়। কোনো কোন বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ তা’য়ালা অভিসম্পাত করেন মদ ও মদপানকারীকে …”। [আবু দাউদ: ৩৬৮১; তিরমিযী: ১৮৬৪, ১৮৬৫; ইবন মাজাহ: ৩৪৫৫, ৩৪৫৬, ৩৪৫৭]
হযরত আবুদ্দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এ মর্মে অসিয়ত করেন:
«لاَ تَشْرَبِ الْـخَمْرَ؛ فَإِنَّهَا مِفْتَاحُ كُلِّ شَرٍّ»
“(কখনো) তুমি মদ পান করো না। কারণ, তা সকল অকল্যাণ ও অঘটনের চাবিকাঠি”। [ইবনে মাজাহ: ৩৪৩৪]
«كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ وَكُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ ، وَفِيْ رِوَايَةٍ: وَكُلُّ خَمْرٍ حَرَامٌ»
“প্রত্যেক নেশাকর বস্তুই মদ বা মদ জাতীয়। আর প্রত্যেক নেশাকর বস্তুই তো হারাম। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, প্রত্যেক মদ জাতীয় বস্তুই হারাম”।[সহীহ মুসলিম: ২০০৩; আবু দাউদ: ৩৬৭৯; ইবনে মাজাহ: ৩৪৫০, ৩৪৫৩]
«كُلُّ شَرَابٍ أَسْكَرَ فَهُوَ حَرَامٌ ، وَبِعِبَارَةٍ أُخْرَى: كُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ»
“প্রত্যেক পানীয় যা নেশাকর তা সবই হারাম। অন্য শব্দে, প্রত্যেক নেশাকর বস্তুই হারাম”। [সহীহ মুসলিম: ২০০১; আবু দাউদ: ৩৬৮২; ইবনে মাজাহ: ৩৪৪৯, ৩৪৫১, ৩৪৫২, ৩৪৫৪]
মুফাসসিরদের উচিৎ, মাদক ও মাদকাসক্তদের নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশে যে কঠোর আইন রয়েছে, জাতির সামনে তা তুলে ধরা। যেমন: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ইয়াবা, সিসা, কোকেন, হেরোইন ও পেথিড্রিন জাতীয় মাদকের ব্যবহার, সেবন, বহন, আমদানি-রপ্তানি বা বাজারজাত করার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়াও বিস্তারিত কঠোর যে আইন আছে, অপরাধীরা সে সম্পর্কে অবহিত হলে; তারা সাবধান হতে পারে। মাদক থেকে দূরে থাকার চিন্তা করতে পারে।
মুফাসসিরদের উচিৎ, মাদকের ভয়াবহতা থেকে মাদকাসক্ত লোকেরা কিভাবে বাঁচতে পারেন, কী উপায়ে মাদকের বেড়াজাল থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে পারবেন; এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ ডাক্তার এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ তুলে ধরার চেষ্টা করা। যেমন: নেশা ছাড়ার জন্য নিজে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন। নিয়মিত শরীর চর্চার বিষয়ে যত্নশীল হোন। নিয়মিত শরীর চর্চার ফলে শরীর থেকে কিছু রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয় যেটা আপনাকে মানসিক ও দৈহিকভাবে ভালো বোধ দিতে সক্ষম। যদি নেশা করা ছেড়ে দেয়ার কারণে আপনার দেহে কোনো অবাঞ্ছিত সমস্যা তৈরি হয়, সেই অজুহাতে আবার নেশা করা শুরু করবেন না। ভালোভাবে মনে করুন এই অবাঞ্ছিত সমস্যার মূল কারণ কী এবং পরবর্তীতে সেই কারণ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। বর্তমান নেশা থেকে বাঁচার জন্য নিজেকে অন্য কোনো নেশা, যেমন: জুয়া খেলা কিংবা ধূমপানের দিকে ঠেলে না দেয়ার বিষয়ে যত্নশীল হোন। এ ব্যাপারে পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব এবং কলিগ বা সহযোগীদের সাহায্য গ্রহণ করুন। যেসব জায়গায় গিয়ে আপনি নেশাদ্রব্য সেবন করতেন কিংবা ক্রয় করতেন, সেসব জায়গায় যাতায়াত বন্ধ করুন। যারা নেশাদ্রব্য সেবন করে না, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করুন এবং যেসব বন্ধুবান্ধব নেশাদ্রব্য সেবন করে তাদের থেকে দূরে থাকুন। নেশা ছাড়ার জন্য মনস্থির করার পর একজন ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন। পরামর্শ মেনে চললে আপনি নেশা ত্যাগ করতে পারবেন। এছাড়া এ সময়ে আপনার শারীরিক চেকআপ প্রয়োজন।
মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে তাফসীরুল কুরআন মাহফিল, ওয়াজ মাহফিল, জুম’য়ার খুতবা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাফসীর, ওয়াজ, আলোচনা ও লেখালেখির মাধ্যমে মুফাসসিররা যদি ভূমিকা পালন করতে পারেন, তুলনামূলক কম সময়ের ব্যবধানে মাদকের ভয়াবহতা থেকে জাতি হয়তো মুক্তি পেতে পারেন; ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ তা’য়ালা! মানবতার কল্যাণে আমাদেরকে যথাযথ ভূমিকা পালনের তাওফীক দিন। আমীন।
[লেখক: সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীন।]