মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ভাবনা
মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার
দুনিয়ার জীবন বড়ই মায়াময়। আকর্ষণীয়। এর চাকচিক্যময় হাতছানি মানুষকে প্রলুব্ধ করে। যদিও এর স্থায়িত্ব কম। ক্ষণস্থায়ী হলেও দুনিয়ার প্রেমে মানুষেরা মশগুল হয়ে পড়ে। অথচ আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: দুনিয়ার জীবন তো প্রতারণাকর জিনিসের ভোগ ছাড়া আর কিছুই নয়। (৩. সূরা আলে ইমরান: ১৮৫)। যারা নিজেদের দ্বীনকে খেল-তামাশা হিসেবে গ্রহণ করে এবং দুনিয়ার জীবন যাদেরকে প্রতারিত করে রাখে, আপনি তাদেরকে বর্জন করুন। আর এই কুরআন দ্বারা তাদের সতর্ক করুন, উপদেশ দিন, যাতে কোনো ব্যক্তি নিজের কৃতকর্মের কারণে ধ্বংস হয়ে না যায়। (৬. সূরা আনয়াম: ৭০)। আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে সতর্ক করে জানিয়ে দিয়েছেন: হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে। আর বড় প্রতারকও (শয়তান) যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারিত না করে। শয়তান তোমাদের শত্রু। অতএব তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করো। সে তো তার অনুসারী দলবলকে আহবান জানায়, যেন তারা সায়ীরের (জাহান্নাম) পথিক হয়ে যায়। (৩৫. সূরা ফাতির: ৫-৬)।
আমরা জানি, দুনিয়ার জীবন প্রথম ও শেষ জীবন নয়। বরং জীবনের ধারাবাহিকতায় একটি স্টেশন মাত্র। রূহের জগত থেকে আলমে আখেরাত অর্থাৎ রূহের জগতে আমাদের অস্তিত্বের সূচনা আর আখেরাতের জগতই আমাদের শেষ এবং আসল ঠিকানা। মাঝখানে দুনিয়ার এ জীবন। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের যাত্রা সমাপ্তির মাধ্যম হলো ইন্তেকাল/মৃত্যু। স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার যেন শেষ নেই। ক্ষণিকের এ জীবনে কত জল্পনা কল্পনা। কিন্তু মালাকুল মাউত হাজির হয়ে গেলে সবকিছুর পরিসমাপ্তি হবে।
বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়ন করো, সে মৃত্যু তোমাদের সাথে অবশ্যই সাক্ষাৎ করবে। অতঃপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে অপ্রকাশ্য ও প্রকাশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে। অতঃপর তোমরা যা আমল করতে সে সম্পর্কে তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন। (৬২. সূরা আল-জুমুয়াহ: ৮)। জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদনকারী। তারপর তোমরা আমারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে। (২৯. সূরা আল-আনকাবুত: ৫৭)। প্রত্যেক উম্মতের জন্য এক নির্দিষ্ট সময় আছে। যখন তাদের সময় আসবে তখন তারা মুহুর্তকালও পিছাতে বা এগুতেও পারবে না। (১০. সূরা ইউনুস: ৪৯)।
হযরত আমর বিন মাইমুন (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, এক লোককে উপদেশ দিতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন, পাঁচটি বিষয়ের আগে পাঁচটি বিষয়ের কদর করো। (তন্মধ্যে একটি হলো) মাউত আসার আগে জীবনের। (তিরমিযী)। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: দুনিয়ার স্বাদ-গন্ধকে বিলুপ্তকারী মাউতকে তোমরা বেশী বেশী স্মরণ করো। (তিরমিযী)।
বর্তমান সময়ে গোটা পৃথিবীতে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজমান। কোভিড-১৯ নিস্তব্ধ একটি পরিবেশ তৈরী করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। কোটি কোটি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু আর লাশের মিছিল যেন থামছে না! আল্লাহ তা’য়ালা! দুনিয়াবাসীকে ক্ষমা করুন। সবাইকে হেফাযতে রাখুন। এই দোয়া করছি। সাথে সাথে আসুন একটু আত্মপর্যালোচনা করি। যারা নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবী করি। পরিচয় উপস্থাপন করি। আমরা নিজেদেরকে এই সময়েও কী বদলাতে পেরেছি? মাউতের জন্য আমরা কী প্রস্তুত? কেননা জীবন আর মৃত্যু; আল্লাহ তা’য়ালা বিনাকারণে সৃষ্টি করেন নি। কুরআনের অমিয় বাণী: যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য; তোমাদের মধ্যে কে আমলের দিক থেকে উত্তম? তিনি মহাপরাক্রমশালী এবং ক্ষমাশীল। (৬৭. সূরা আল-মূলক: ২)। ৩. সূরা আলে-ইমরানের ১০২ আয়াতে কারীমায় ঈমানদারদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’য়ালা জানিয়ে দিয়েছেন: এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।
বাবা মুসলিম। তাই আমরাও মুসলিম। আসলে মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেই প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মুসলিম হওয়া যায় না। আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশ পালন এবং নিষেধ বর্জনই আমাদের মুসলিম বানাতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা:) এর দেখানো পথ তথা সীরাতে মুস্তাকীমে অটল অবিচল থাকতে পারলেই আমরা নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো, ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা: হে ইমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো। (২. সূরা আল-বাকারাহ: ২০৮)।
আল্লাহ ও রাসেলের নির্দেশ আমরা অহরহ অমান্য করি। অথচ দাবী করি আমরা মুসলিম। মিথ্যার সাথে আমাদের বসবাস। আল্লাহ তায়া’লা জানিয়ে দিয়েছেন: এবং মিথ্যা কথা থেকে দূরে থাকো। (২২. সূরা আল-হাজ্জ: ৩০)। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, তোমরা মিথ্যাচার থেকে বেঁচে থাকো, কেননা মিথ্যা পাপের দিকে আর পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। (বুখারী ও মুসলিম)। দুনিয়ায় একটু সুযোগ সুবিধা কিংবা ক্ষমতা প্রতিপত্তি পেলেই আমরা অহংকারী হয়ে যাই। আর আল্লাহ তা’য়ালা জানিয়ে দিয়েছেন: যমিনে গর্বের সাথে চলবে না। নিশ্চয়ই তুমি মাটিকে ফাটিয়ে দিতে পারবে না এবং পাহাড়ের সমান উঁচু হতেও পারবে না। (১৭. সূরা বনী-ইসরাঈল: ৩৭)। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা:) বলেছেন: যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার রয়েছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (হাদীসের শেষ দিকে বলা হয়েছে) অহংকার হলো, গর্বভরে সত্যকে অস্বীকার করা এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা। (মুসলিম)। এছাড়াও বড় কিংবা ছোট গুণাহ আমরা অহরহ করছি। হিংসা, মুনাফেকি আচরণ, যুলুম, সুদী কাজ-কর্ম, মদ, জুয়া, যেনা-ব্যভিচার, সন্ত্রাস, অবৈধ উপার্জন এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মতো গুণাহ করে যাচ্ছি। এরপরও দাবী করছি আমরা মুসলমান।
প্রকৃত মুসলিম হতে হলে খাঁটি ও পূর্ণ মু’মীন হওয়া জরুরী। হযরত আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: যে ব্যক্তির মধ্যে তিনটি জিনিস পাওয়া যাবে, সে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করেছে। এক. তার মাঝে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের মহব্বত, দুনিয়ার সব বস্তু অপেক্ষা বেশী হবে। দুই. যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মহব্বত করে এবং তিন. যে ব্যক্তি কুফরির অন্ধকার থেকে বের হয়ে ঈমান ও ইসলামের আলো গ্রহণ করার পর আবার কুফরির অন্ধকারে ফিরে যাওয়াকে এতো মন্দ মনে করে যেমন মনে করে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে। (বুখারী ও মুসলিম)।
কে ক’দিন এই দুনিয়ায় আছি জানি না! তাই আসুন, নিজেকে প্রস্তুত করি। অনন্তকালের জগতে যেন সফল হতে পারি। আলমে আখেরাতে যেন চিরশান্তিতে থাকতে পারি। জান্নাতের সুশীতল ছায়াতলে যেন আশ্রয় পাই। আসুন, আল্লাহর ভয়ে ভীত হই। রাসুলের আদর্শকে উসওয়ায়ে হাসানাহ হিসেবে গ্রহণ করি। হক্বকে আঁকড়ে ধরি। সবর, ক্ষমা ও বিনয়ের গুণে গুণান্বিত হই। সালাতসহ ফরজ ইবাদাতে যত্নবান থাকি। সুন্নত কিংবা নফলের ব্যাপারেও যেন গাফিল না থাকি। আল্লাহ তা’য়ালা! তাওফীক দিন। দ্বীনের আলোয় আমাদের জীবনকে আলোকিত করুন। সবাইকে ভালো ও হেফাযতে রাখুন। আমীন।
লেখক: সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীন।
শেয়ার করুন