আল্লাহর উপর ভরসা : মু’মিনের শ্রেষ্ঠ গুণ

মুক্তমত

মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার

আল্লাহ ভরসা। বাক্যটি ব্যাপক পরিচিত ও প্রচলিত। কোনো কাজ সম্পাদন করার সময়, কাউকে উজ্জীবিত করতে কিংবা সান্ত্বনা দিতে এই বাক্যটি আমাদের মুখ থেকে স্বাভাবিকভাবেই উচ্চারিত হয়। ঈমানদারদের শ্রেষ্ঠ গুণ আল্লাহর উপর ভরসা করা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর নির্ভরতা অপরিহার্য।

তার কোন আধিপত্য নেই তাদের উপর যারা ঈমান আনে ও তাদের রবের উপরই নির্ভর করে। [১৬. সূরা নাহল: ৯৯]। সুফিয়ান সাওরী বলেন, যারা আল্লাহর উপর ভরসা রাখে শয়তান তাদেরকে এমন গোনাহে লিপ্ত করতে পারে না যা থেকে সে তাওবাহ করে না। কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ: যারা আল্লাহর উপর ভরসা রাখে শয়তান তাদের কাছে কোনো প্রমাণ দিয়ে টিকে থাকতে পারে না।

যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। [৬৫. সূরা তালাক: ৩]। হযরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যদি তোমরা আল্লাহর উপর যথাযথ ভরসা করতে, তবে আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে পাখির ন্যায় রিযিক দান করতেন। পাখি সকাল বেলায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাসা থেকে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় উদরপূর্তি করে ফিরে আসে।” [মুসনাদে আহমাদ: ১/৩০, তিরমিযী: ২৩৪৪, ইবনে মাজাহ: ৪১৬৪]।

আর আমার কৃতকার্যতা তো শুধু আল্লাহরই সাহায্যে; আমি তাঁরই উপর ভরসা রাখি এবং আমি তাঁরই অভিমুখী। [১১. সূরা হুদ: ৮৮]। অর্থাৎ, সত্য পর্যন্ত পৌঁছনোর আমার যে প্রবল ইচ্ছা, তা একমাত্র আল্লাহর তওফীক বা সাহায্যেই সম্ভব। এই জন্য প্রত্যেক কাজে আমি আল্লাহরই উপর ভরসা রাখি এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করি। [আহসানুল বায়ান]।

মু’মিনদের উচিত আল্লাহরই উপর ভরসা করা। [১৪. সূরা ইব্রাহীম: ১১]। এখানে ‘বিশ্বাসীদের’ বলে উদ্দেশ্য প্রথমত নবীগণ। অর্থাৎ আমাদের উচিত, আল্লাহর উপরেই সম্পূর্ণ ভরসা রাখা। যেমন পরবর্তী আয়াতে বলেছেন, ‘আর আমরা কেন আল্লাহর উপর ভরসা করবো না, অথচ তিনিই আমাদেরকে আমাদের পথের দিশা দিয়েছেন। আর তোমরা আমাদের যে কষ্ট দিচ্ছো, আমরা তার উপর অবশ্যই সবর করবো। আর আল্লাহর উপরই যেন ভরসাকারীরা ভরসা করে’। ভরসা এই যে, তিনিই কাফেরদের বদমায়েশি ও মূর্খামি থেকে রক্ষাকারী। এই অর্থও হতে পারে যে, আমাদের কাছে মু’জিযা তলব না করে আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিত। তাঁর ইচ্ছা হলে তিনি মু’জিযা প্রকাশ করবেন, না হলে না। [আহসানুল বায়ান]।

যদি তোমরা তাকে (রাসূলুল্লাহকে) সাহায্য না করো তাহলে আল্লাহই তাকে সাহায্য করবেন যেমন তিনি তাকে সাহায্য করেছিলেন সেই সময়ে যখন কাফিরেরা তাকে দেশান্তর করেছিলো, যখন দু’জনের মধ্যে একজন ছিলো সে, যে সময় উভয়ে গুহার মধ্যে ছিলো, যখন সে স্বীয় সঙ্গীকে (আবূ বকরকে) বলেছিলো: তুমি বিষণ্ণ হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাকে শক্তিশালী করলেন এমন সেনাদল দ্বারা যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি এবং আল্লাহ কাফিরদের বাক্য নীচু করে দিলেন, আর আল্লাহর বাণী সমুচ্চ রইলো, আর আল্লাহ হচ্ছেন প্রবল প্রজ্ঞাময়। [৯. সূরা তাওবাহ: ৪০]। এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের ঘটনা উল্লেখ করে দেখিয়ে দেয়া হয় যে, আল্লাহর রাসূল কোন মানুষের সাহায্য সহযোগিতার মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহ প্রত্যক্ষভাবে গায়েব থেকে সাহায্য করতে সক্ষম। যেমন হিজরতের সময় করা হয়, যখন তার আপন গোত্র ও দেশবাসী তাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করে। সফরসঙ্গী হিসেবে একমাত্র সিদ্দীকে আকবর (রা.) ছাড়া আর কেউ ছিলো না। পদব্রজী ও অশ্বারোহী শক্ররা সর্বত্র তার খোঁজ করে ফিরছে। অথচ আশ্রয়স্থল কোন মজবুত দুর্গ ছিলো না। বরং তা এক গিরী গুহা, যার দ্বারপ্রান্তে পর্যন্ত পৌছেছিল তার শক্ররা। তখন গুহা সঙ্গী আবু বকর (রা.)-এর চিন্তা নিজের জন্য ছিলো না, বরং তিনি এই ভেবে সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন যে, হয়তো শক্ররা তার বন্ধুর জীবন নাশ করে দেবে, কিন্তু সে সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন পাহাড়ের মত অনড়, অটল ও নিশ্চিত।

শুধু যে নিজের তা নয়, বরং সফর সঙ্গীকেও অভয় দিয়ে বলছিলেন, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (অর্থাৎ তাঁর সাহায্য আমাদের সাথে রয়েছে।) আবু বকর (রা.) বলেন, আমি গিরী গুহায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে ছিলাম। তখন আমি কাফেরদের পদশব্দ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের কেউ যদি পা উচিয়ে দেখে তবে আমাদের দেখতে পাবে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে দুজনের সাথে আল্লাহ তৃতীয়জন তাদের ব্যাপারে তোমার কি ধারণা? [বুখারী: ১৭৭]।

মু’মিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের উপরই ভরসা করে। [৮. সূরা আনফাল: ২]। মু’মিনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা আল্লাহ্ তা’য়ালার উপর ভরসা করবে। তাওয়াক্কুল অর্থ হলো আস্থা ও ভরসা। অর্থাৎ নিজের যাবতীয় কাজ-কর্ম ও অবস্থায় তার পরিপূর্ণ আস্থা ও ভরসা থাকে শুধুমাত্র একক সত্তা আল্লাহ তা’আলার উপর। [ইবন কাসীর]।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বনী ইসরাঈলের কোনো এক ব্যক্তি বনী ইসরাঈলের অপর ব্যক্তির নিকট এক হাজার দীনার ঋণ চাইলো। তখন সে (ঋণদাতা) বললো, কয়েকজন সাক্ষী আনো, আমি তাদের সাক্ষী রাখবো। সে বললো, সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। তারপর ঋণদাতা বললো, তাহলে একজন যামিনদার উপস্থিত করো। সে বললো, যামিনদার হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। ঋণদাতা বললো, তুমি সত্যিই বলেছো। এরপর নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের শর্তে তাকে এক হাজার দীনার দিয়ে দিলো। তারপর ঋণ গ্রহীতা সামুদ্রিক সফর করলো এবং তার প্রয়োজন সমাধা করে সে যানবাহন খুঁজতে লাগলো, যাতে সে নির্ধারিত সময়ের ভেতর ঋণদাতার কাছে এসে পৌঁছতে পারে। কিন্তু সে কোন যানবাহন পেলো না। তখন সে এক টুকরো কাঠ নিয়ে তা ছিদ্র করলো এবং ঋণদাতার নামে একখানা পত্র ও এক হাজার দীনার তার মধ্যে ভরে ছিদ্রটি বন্ধ করে সমুদ্র তীরে এসে বললো, হে আল্লাহ! তুমি তো জানো, আমি অমুকের নিকট এক হাজার দীনার ঋণ চাইলে সে আমার কাছে যামিনদার চেয়েছিলো। আমি বলেছিলাম, আল্লাহই যামিন হিসাবে যথেষ্ট। এতে সে রাজি হয়। তারপর সে আমার কাছে সাক্ষী চেয়েছিলো, আমি বলেছিলাম, সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। তাতে সে রাযী হয়ে যায়। আমি তার ঋণ (যথাসময়ে) পরিশোধের উদ্দেশ্যে যানবাহনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু পাই নি। তাই আমি তোমার নিকট সোপর্দ করলাম। এই বলে সে কাষ্টখন্ডটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করলো। আর কাষ্ঠখন্ডটি সমুদ্রে প্রবেশ করলো। অতঃপর লোকটি ফিরে গেলো এবং নিজের শহরে যাওয়ার যানবাহন খুঁজতে লাগলো। ওদিকে ঋণদাতা এই আশায় সমুদ্রতীরে গেলো যে, হয়ত বা ঋণগ্রহীতা কোনো নৌযানে করে তার মাল নিয়ে এসেছে। তার দৃষ্টি কাষ্ঠখন্ডটির উপর পড়লো, যার ভিতরে মাল ছিলো। সে কাষ্টখন্ডটি তার পরিবারের জ্বালানীর জন্য বাড়ী নিয়ে গেলো। যখন সে তা চিরলো, তখন সে মাল ও পত্রটি পেয়ে গেলো। কিছুদিন পর ঋণগ্রহীতা এক হাজার দীনার নিয়ে হাজির হলো এবং বললো, আল্লাহর কসম! আমি আপনার মাল যথাসময়ে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে সব সময় যানবাহনের খোঁজে ছিলাম। কিন্তু আমি যে, নৌযানে এখন আসলাম, তার আগে আর কোন নৌযান পাই নি। ঋণদাতা বললো, তুমি কি আমার নিকট কিছু পাঠিয়েছিলে? ঋণগ্রহীতা বললো, আমি তো তোমাকে বললামই যে, এর আগে আর কোন নৌযান আমি পাই নি। সে বললো, তুমি কাঠের টুকরোর ভিতরে যা পাঠিয়েছিলে, তা আল্লাহ তোমার পক্ষ হতে আমাকে আদায় করে দিয়েছেন। তখন সে আনন্দচিত্তে এক হাজার দীনার নিয়ে ফিরে চলে এলো’ [বুখারী হা/২২৯১; ‘কিতাবুল কিফালাহ’]।

বিপদে মুসীবতে আল্লাহর উপর ভরসাই রক্ষা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। এই মানসিকতা আমাদের অন্তরে লালিত হওয়া উচিৎ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন ইবরাহীম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্ম বিধায়ক। একথা ইবরাহীম (আ.) বলেন, যখন তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়’ [বুখারী, রিয়াদুস সালেহীন, ১ম খন্ড, হা/৭৬]। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণকারী। আমাদের হেফাযতকারী। তিনিই হায়াত-মউত ও রিযিকের মালিক। আসুন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ভরসা রাখি। আল্লাহ তা’য়ালা! অনন্য এই গুণে আমাদের গুণান্বিত করুন। আমীন।।

[লেখক: সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীন।]

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *