দেশে বিভিন্ন অঞ্চলভেদে রয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। অনেক এলাকায় পানিতে থাকছে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন। ফলে তীব্র সুপেয় পানির সংকটে দুর্ভোগ নেমে আসে জনজীবনে। সিলেট অঞ্চলও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এই বিশুদ্ধ পানির সংকট মোকাবিলায় ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) কর্তৃপক্ষ।
৯১ লাখ ১ হাজার ২১১ টাকা ব্যয়ে স্থাপিত এই প্ল্যান্টের মাধ্যমে ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে অতি স্বল্প খরচে ঘণ্টায় ৩০ হাজার লিটার পরিশোধনে পূরণ হচ্ছে ক্যাম্পাসের প্রায় ৭০ শতাংশ বিশুদ্ধ পানির চাহিদা। এসব প্ল্যান্ট পুরোপুরি চালু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপেয় পানির সংকট অনেকটা মিটে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, শাহপরান ও মুজতবা আলী হলে আলাদা করে দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বসানো হয়েছে। সেখান থেকে ঘণ্টায় ৩০ হাজার লিটার সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি দুটি ট্যাংকে রিজার্ভ রাখা হচ্ছে দেড় লাখ লিটার পানি। প্ল্যান্টগুলোর কনসালটেন্ট হিসেবে একুয়া সলিউশন লিমিটেড এবং ঠিকাদার হিসেবে রয়েছে গ্রিন গ্লোবাল ট্রেডার্স।
এ বিষয়ে কথা হয় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. এনামুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই প্ল্যান্টের পানি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেন্সি (সিআরটিসি সাস্ট) থেকে ১৫টি পরীক্ষা করে উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব পরীক্ষায় দেখা গেছে এখানের পরিশোধিত পানি দেশের অন্যান্য মিনারেল থেকেও অনেক পরিষ্কার, স্বচ্ছ এবং বিশুদ্ধ।
এছাড়া এ প্ল্যান্ট দুটি থেকে দিনপ্রতি সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০০ টাকা খরচে ৩ লাখ ৬০ হাজার লিটারের বেশি সুপেয় পানি পাওয়া যাবে। তাতে ১ টাকায় ২’শ লিটারের বেশি সুপেয় পানি মিলবে এসব প্ল্যান্ট থেকে। তবে প্ল্যান্টগুলোর ভালো সার্ভিস পেতে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পানি পরিশোধন প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।
সরেজমিনে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, প্ল্যান্টের পানি প্রথমে ডিপ টিউবওয়েল থেকে এসোশন টাওয়ারে পানি নিয়ে আসা হয়। এরপর প্লো-কুলেশন ট্যাংক থেকে সেডি মেন্ট্রোশন ট্যাংকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান কয়েক ধাপে পরিশোধিত হয়ে ফিড পাম্পের মাধ্যমে ভেসেলে ট্রান্সফার হয়। পরে তিনটি ভেসেল হয়ে মাল্টি গ্রেড ফিল্টারে আসার পর আয়রন রিমুভাল ফিল্টারে যায়। সেখান থেকে অ্যাক্টিভেট কার্বন ফিল্টার ও মাইক্রো ফিল্টারেশন সিস্টেম থেকে ফ্লো মিটার হয়ে রিজার্ভে পানি জমা হয়।
রিজার্ভ ট্যাংকে থেকে লিফটিং পাম্পের মাধ্যমে বিভিন্ন পাইপ দিয়ে শাহপরান হল, বঙ্গবন্ধু হল, কর্মচারী কোয়ার্টার, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব, ইউনিভার্সিটি সেন্টার এবং একাডেমি ভবন বি-তে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে সৈয়দ মুজতবা আলী হলের জন্য আলাদা একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট রয়েছে। এছাড়া জরুরি প্রয়োজনে আরও দুটি লিফটিং পাম্প রিজার্ভ রাখা হয়েছে।
এদিকে ১৫ আগস্ট থেকে প্ল্যান্টগুলোতে পরীক্ষণমূলকভাবে পানি পরিশোধন করা হচ্ছে। এতে দিনপ্রতি ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে। উদ্বোধনের পর থেকে পুরোপুরি সচল হবে প্ল্যান্টগুলো।
পাম্প অপারেটর মো. জাকির হোসেন বলেন, এখানে পানি বিশুদ্ধিকরণে প্যাক কেমিক্যাল, পলি ইলেক্ট্রোলাইট, সোডিয়াম হাইপোক্লোরাউড কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ১৯টি মটর দিয়ে পানি বিশুদ্ধিকরণ হয়। উত্তোলন শেষে আয়রন দুবার ব্যাকওয়াশ করা হয়। তবে প্লান্ট পরিচালনায় শুধু একজন থাকায় একটু বেগ পেতে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ও লোকপ্রশাসন বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী আশরাফুল আলম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় পানি শোধনাগার চালুর পর থেকে হলের শিক্ষার্থীরা এর সুফল ভোগ করছেন। পানিতে প্রচুর আয়রন থাকত। ফলে দাঁতে কালচে দাগ হয়ে যেত, মাথার চুল পড়ে যেত, নতুন কাপড় যেত নষ্ট হয়ে। এছাড়াও স্কিনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছিলাম।
তিনি বলেন, হলে এখন পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ এবং স্বচ্ছ পানি ব্যবহার করতে পারছি। এমন উদ্যোগে শিক্ষার্থীরা অনেক খুশি। তাই প্রশাসনের প্রতি শোধনাগারটি নিয়মিত তদারকির আহ্বান জানান আশরাফুল।
সৈয়দ মুজতবা আলী হলের আবাসিক ও রসায়ন বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী নাঈম বিন ইমরান বলেন, আগে আবাসিক ছাত্রদের প্রায়ই আয়রনের বাজে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। পানি সরাসরি পান করা যেত না। আমাদের পোশাক অল্প সময়ে নষ্ট হয়ে যেত। বিশেষ করে সাদা পোশাক নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। এখন আয়রন রিমুভালের কারণে সেসব সমস্যা থেকে মুক্ত হয়ে বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছি, যেটা সরাসরি পান করা যোগ্য। এখন অন্যান্য সমস্যাও কমে এসেছে। প্রশাসনের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
সৈয়দ মুজতবা আলী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আবু সাঈদ আরেফিন খান বলেন, আগে হলে বিশুদ্ধ পানির সংকট থাকায় পিউরিফাই করতে মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ করতে হতো। এখন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট হওয়াতে অতিঅল্প খরচে অনেক বেশি এবং শতভাগ বিশুদ্ধ পানি শিক্ষার্থীদের দিতে পারছি। আমার চাই শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষা পরিবেশে থেকে পড়াশোনা করুক। তাই এমন পরিবেশ উপহার দেওয়ার চেষ্টা সবসময় অব্যাহত রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপেয় পানির সংকট ছিল। পানিতে অতিরিক্ত আয়রন ছিল। ভালোভাবে সুপেয় পানি পাওয়া যেত না। তাই দীর্ঘদিনের এ সংকট মোকাবিলা করতে আমরা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করেছি। যা দিয়ে ক্যাম্পাস ও হলের অধিকাংশ সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, এখানের পানি অনেক স্বচ্ছ, সুপেয় এবং বিশুদ্ধ। সামনে আমাদের আরও উদ্যোগ রয়েছে। আবাসিক শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাসে সুপেয় পানি নিশ্চিত করার ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
শেয়ার করুন