সিলেটে ৫ শতাধিক ডাক কর্মচারীর দুর্দশার গল্প

সিলেট

৯ অক্টোবর, বিশ্ব ডাক দিবস। আজ (বুধবার) ‘নিজেদের’ এই দিনে ডাক কর্মচারী মিলন মিয়ার কিছুটা হলেও আনন্দিত থাকার কথা, কিন্তু বছরের বেশিরভাগ দিনের মতোই তিনি বিমর্ষ। প্রতি বছর বিশ্ব ডাক দিবসের আসা-যাওয়া হাসি ফুটায় না মিলন মিয়ার মতো সিলেটের ৫ শতাধিক ডাক কর্মচারীর মুখে। কারণ- তারা ডাক বিভাগের ইডি (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল) ব্রাঞ্চে কর্মরত। যাদের মাসিক বেতন সর্বসাকুল্যে মাত্র ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকার মধ্যে।
মিলন মিয়া সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজার ইউনিয়নের জাফারাবাদ শাখা ডাকঘরের ইডিএমসি (রানার)। প্রতিদিন তার ডাকঘরের চিঠির ব্যাগ বহন করাই মিলনের দায়িত্ব। মাসিক বেতন ৪ হাজার ৩ শ টাকা। এই বেতনে মিলন মিয়ার সংসারে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ কথাটিও বড্ড বেমানান। কারণ- এই টাকায় ৭ জনের সংসারে ভাতের সঙ্গে নুনও জোগান দেওয়া তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।

সিলেট প্রধান ডাকঘর সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগে সাড়ে ৩শ’টি ‘এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল ব্রাঞ্চ অফিস’ রয়েছে। এসব ডাকঘরে ৩ জন কর্মচারী থাকেন। পোস্ট মাস্টার পদমর্যাদার একজন ‘ইডিএ’ (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল এজেন্ট), পোস্টম্যান পদমর্যাদার ‘ইডিডিএ’ (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল ডেলিভারি এজেন্ট) একজন এবং একজন রানার পদমর্যাদার ‘ইডিএমসি’ (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল মেইল ক্যারিয়ার)। এর মধ্যে ‘ইডিএ’র মাসিক বেতন ৪ হাজার ৪৭৫, ‘ইডিডিএ’র ৪ হাজার ৩৫০ এবং ‘ইডিএমসি’র মাসিক বেতন মাত্র ৪ হাজার ৩০০ টাকা।
সিলেট বিভাগের এমন সাড়ে ৩ শ ডাকঘরে বর্তমানে প্রায় ৭০০ জন ইডিএ, ইডিডিএ ও ইডিএমসি কর্মরত রয়েছেন। কোনো উৎসব ও আনন্দভাতা নেই তাদের, নেই কোনো পেনশন বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সামান্য নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত হলেও তারা ডাকবিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতোই নিষ্টার সঙ্গে নিয়ম মেনে প্রতিদিনের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
সিলেটের বিভিন্ন ‘এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল ব্রাঞ্চ অফিস’-এ কর্মরতদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা আক্ষেপ করে জানান- এই দুর্মূল্যের বাজারে সামান্য এ টাকায় তাদের সংসার চালানো তো দূরের কথা, হাতখরচও হয় না। বহু বছরের বঞ্চনার অবসান ও একটা সম্মানজনক জীবনের আশায় এসব ডাকঘরের কর্মচারীরা দীর্ঘদিন যাবৎ তিনগুণ ভাতা বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছেন। দাবি আদায়ের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ পোস্টাল ইডি কর্মচারী ইউনিয়নের ব্যানারে সিলেটসহ সারা দেশে বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন, কর্মবিরতি ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি পালন করেন তারা। কিন্তু কোনো কিছুতেই তাদের দাবি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।

সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষণাবন্দ ইউনিয়নের কৈলাস শাখা ডাকঘরের ইডিএ মো. জিল্লুর রহমান নিজের দুর্ভাগ্য ও বঞ্চনার কথা জানাতে গিয়ে বলেন- চাকরির বয়স দুই যোগেরও বেশি হয়ে গেছে। প্রথমে ছিলো মাসিক বেতন ১২০০ টাকা, পরে বাড়িয়ে করা হয় ২২০০ টাকা, এখন পাই মাসে মাত্র চার হাজার ৪৭৫ টাকা। এই বেতনের কথা কাউকে লজ্জায় বলতে পারি না। সংসার চলে না, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ দিতে পারি না। ধার-কর্জ করে দিনে দিনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা আর পারছি না। এবার সরকার আমাদের দিকে একটু চোখ তুলে তাকাক। আমরা সম্মানজনক একটা জীবন চাই।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার লালাবাজার ইউনিয়নের পশ্চিমভাগ শাখা ডাকঘরের ইডিডিএ জগদিশ চন্দ্র নাথ বলেন- আমাদের যে সম্মানীভাতা দেয়া হয়, তা খুবই অসম্মানজনক। আমরা এই বঞ্চনার অবসান চাই। তিনি বলেন, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। কত টাকা ভাতা পাই তা সন্তানদের কাছেও বলতে পারি না।
বাংলাদেশ পোস্টাল ইডি কর্মচারী ইউনিয়ন সিলেট জেলা শাখার (একাংশ) সভাপতি, বিশ্বনাথ উপজেলার পনাউল্লাহ শাখা ডাকঘরের ইডিএ আশরাফ আলী সিলেটভিউ-কে জানান, দুই যোগেরও বেশি সময় ধরে দাবি-দাওয়া আদায়ে তারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। সময়ে সময়ে ভাতা কিছুটা বাড়লেও সেটি কোনোভাবেই সম্মানজনক পর্যায়ে আসেনি। এখন তাদের মূল দাবি- বর্তমান সম্মানীভাতা তিনগুণ বৃদ্ধি করা। এছাড়াও দুই মাসের ভাতার সমান দু’টি উৎসবভাতা প্রদান করা।

তিনি আরও জানান- এসব দাবি আদায়ে তারা বিভিন্নভাবে সোচ্চার রয়েছেন। সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসে সিলেটে সংগঠনের জেলা কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সভা থেকে তারা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।
আগামী নভেম্বরের মধ্যে দাবি আদায় না হলে তারা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবেন বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন আশরাফ আলী।
ইডি ব্রাঞ্চে কর্মরতদের সম্মানী বৃদ্ধির বিষয়ে সিলেট প্রধান ডাকঘরের সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল (এপিএমজি) সুজিত চক্রবর্তী সিলেটভিউ-কে বলেন- আমরাও চাই তাদের সম্মানী বাড়ুক। তবে এতে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে ডাক বিভাগকে। ডাক মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবনা পাঠাতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। তারপরে পেতে হবে চূড়ান্ত অনুমোদন।

তিনি বলেন- তবে আশার কথা হচ্ছে, ইডি ব্রাঞ্চে কর্মচারীদের বেতনবৈষম্য দূর করতে ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশনায় এসব ব্রাঞ্চে ই-সেন্টার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে ইডি কর্মচারীরা কিছুটা লাভবান হচ্ছেন। আশা করি তাদের সম্মানী বৃদ্ধির দাবিও প্রধানমন্ত্রী সুনজরে নেবেন।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন (ইউপিইউ) প্রতিবছরের ৯ অক্টোবর ডাক দিবস হিসেবে পালন করে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ডাক অধিদপ্তর এ দিবসটি পালন করছে। তবে এবার ৯ অক্টোবর ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) হওয়ায় কোনো কর্মসূচি পালিত হয়নি।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘পোস্ট ফর প্ল্যানেট’ বা ‘বিশ্বের জন্য ডাকঘর’।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *