মেট্রো ও জেলা মিলিয়ে সিলেটে বৈধ সিএনজি-অটোরিকশা রয়েছে ১৯ হাজার ২৩৪টি। বিআরটিএ থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে এসব গাড়ি চলছে। তবে মালিক শ্রমিকদের তথ্য; সিলেট মেট্রো ও জেলাতে অন্তত ৩৫ হাজার সিএনজি-অটোরিকশা চলছে। এরমধ্যে অনটেস্ট ও চোরাই সিএনজি-অটোরিকশার সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। ‘টোকেন বাণিজ্যে’ চলে রেজিস্ট্রেশনবিহীন এসব অটোরিকশা। ১ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে পরিশোধ করে বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন নিয়ে এসব অটোরিকশা চলাচল করে। আর তাই পুলিশ আটক করে না। চালকদেরও ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রয়োজন পড়ে না। হিসাবে দেখা গেছে; প্রতি মাসে অবৈধ অটোরিকশা থেকে কোটি টাকা টোকেন বাণিজ্য হয়। আর এতে জড়িত মাঠপর্যায়ে কিছু পুলিশ ও কয়েকজন পরিবহন শ্রমিক নেতা।
সিএনজি পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, টোকেন বাণিজ্যকে জিইয়ে রাখতে অবৈধ ও চোরাই গাড়ির বিরুদ্ধে অ্যাকশন হয় না। নতুন পুলিশ কমিশনার মো. ইলিয়াস শরীফ সিলেটে যোগদানের পর পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। আর ওই বৈঠকে মালিক ও পরিবহন শ্রমিক নেতারা পুলিশ কমিশনারের কাছে রেজিস্ট্রেশনবিহীন অবৈধ অটোরিকশা সম্পর্কে নালিশ দেন। জানান টোকেন বাণিজ্যের কথাও। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় ওই বৈঠকে। পুলিশ কমিশনার সব শুনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। বৈঠকে সিলেট জেলা সিএনজি-অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন ও শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি জাকারিয়া আহমদসহ কয়েকজনের বক্তব্যে এসব অভিযোগ উঠে এসেছিল।
মালিক সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, অবৈধ সিএনজি-অটোরিকশা সিলেট নগরীতে যানজটের অন্যতম কারণ। বৈধ সিএনজি মালিক ও শ্রমিকরা তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন। অবৈধ সিএনজি অটোরিকশা বেশি হওয়ার কারণে গ্যাস সংকটও চরমে পৌঁছেছে। এজন্য সম্প্রতি সময়ে বৈধ মালিক ও শ্রমিকরা বিষয়টি নিয়ে স্বোচ্ছার। প্রায় ২ বছর আগের কথা। নগরীর দক্ষিণ সুরমার লাউয়াই এলাকার একটি গ্যারেজে কক্সবাজার থেকে কাভার্ডভ্যান যোগে নিয়ে আসা হয় ৪টি চোরাই সিএনজি। খালাস করছিল চোরাকারবারিরা। খবর পেয়ে সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির নেতারা পুলিশ নিয়ে সেখানে যান। ৩ চোরাকারবারিসহ আটক করা হয় ৪টি সিএনজি ও কাভার্ডভ্যান।
একই সময়ে মালিক সমিতির নেতাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে শহরতলীর কলাবাগান এলাকার একটি গ্যারেজে অভিযান চালিয়ে ৬টি সিএনজি-অটোরিকশা আটক করা হয়। এভাবে প্রায় সময় সিলেটে অভিযান চালিয়ে সিএনজি-অটোরিকশা আটক করা হলেও চোরাই গাড়ি আসা বন্ধ হচ্ছে না।
পরিবহন শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, সিলেটে এখনো আসছে চোরাই বা আনফিট সিএনজি। বিভিন্ন জেলা থেকে কাভার্ডভ্যানে করে শহরতলীর গহরপুর, জালালপুর, কুচাই, মেজরটিলা, নাজিরবাজার, গাছবাড়ী ও সড়কের বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় কাভার্ডভ্যান করে গাড়ি নিয়ে আসে চোরাকারবারিরা। এ সংখ্যা বর্তমানে ৫ হাজার অতিক্রম করেছে। সম্প্রতি সময়েও হাজারো চোরাই সিএনজি-অটোরিকশা এসে সিলেটে ঢুকেছে। এই চোরাই সিএনজির মূল্য কম হওয়ার কারণে ক্রেতারা সহজেই ওয়ার্কশপে নিয়ে গাড়ির রং পরিবর্তনের মাধ্যমে রাস্তায় ছাড়ে।
২০১৪ সাল থেকে সিলেট বিআরটিএতে সিএনজি-অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন দেয়া বন্ধ আছে। না দেয়ার কারণও যৌক্তিক। কারণ যে পরিমাণ বৈধ সিএনজি-অটোরিকশা রয়েছে সেগুলোতেও যানজট বেধে যায়। এ কারণে নতুন রেজিস্ট্রেশন দেয়ার কথা উঠলেই নাগরিক সমাজ থেকে আপত্তি আসে।
পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, সিলেটে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা টোকেন বাণিজ্যের নামে এসব চোরাই ও অনটেস্ট সিএনজি রাস্তায় চলে এবং প্রায় সব সিএনজি-অটোরিকশাই গ্যাস সংগ্রহের কারণে নগরে ঢুকতেই হচ্ছে। ফলে নগরে অতিরিক্ত যানজট হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, এসব সিএনজি-অটোরিকশা টোকেন বাণিজ্যে সিলেট মেট্রো ও জেলা পুলিশের কয়েজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর জড়িত। তারা নগরের দক্ষিণ অংশের চন্ডিপুল ও কদমতলী এলাকা এবং উত্তর অংশের কুমারগাঁও, আম্বরখানা, শিবগঞ্জ, টিলাগড় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। পরিচিত কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে দিয়ে তারা টোকেন বাণিজ্যের পসরা সাজিয়েছেন।
অবৈধ ও চোরাই গাড়ির চলাচলে একেক রুটে একেক নেতা দায়িত্ব রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ সুরমায় আলতাব হোসেন। তার নিজের নামে কয়েকটি সিএনজি-অটোরিকশা রয়েছে। আর জগন্নাথপুর, ওসমানীনগর, বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জসহ দক্ষিণ অংশের দেখভাল করেন তিনি। এয়ারপোর্ট রুটের দায়িত্বে শ্রমিক নেতা আবুল মিয়া। হরিপুর জৈন্তা ও কানাইঘাট অংশের নিয়ন্ত্রণ করে নুরুল এক নামের একজন। আর গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন উজ্জ্বল মিয়া নামে একজন। তারা ট্রাফিক পুলিশ ও থানা নিয়ন্ত্রণ করে এসব সিএনজি-অটোরিকশাকে সিলেটে ঢুকতে সুবিধা করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব শ্রমিক নেতারা এখন মাসে নিজেরাই ১৫-২০ লাখ টাকা আয় করেন।
তবে রুট নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন শ্রমিক নেতা আলতাব হোসেন, আবুল মিয়াসহ অন্যরা। তারা জানিয়েছেন, ‘এগুলো কে, কীভাবে চালায় আমরা জানি না। শ্রমিক সংগঠনগুলো এগুলো নিয়ন্ত্রণ করলেও করতে পারে। এসবে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
সিলেট জেলা সিএনজি-অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাকারিয়া আহমদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘টোকেন বাণিজ্যের কারণে অবৈধ ও চোরাই সিএনজি-অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না। এতে করে বৈধ সিএনজি মালিক ও শ্রমিকরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। বার বার অভিযান করা হলেও এগুলো বন্ধ হয় না বলে জানান তিনি।’
সিলেট নগর ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম দস্তগীর জানিয়েছেন, সিলেটে চলাচলকারী সকল সিএনজি-অটোরিকশাতে বারকোড স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বারকোড লাগানো থাকলেই প্রযুক্তির মাধ্যমে চোরাই ও অনটেস্ট সিএনজি নির্ণয় করা সম্ভব হবে। এতে করে টোকেন বাণিজ্যের যে অভিযোগ এসেছে সেটি বন্ধ করা সম্ভব হবে। আর চোরাই গাড়ি ধরতে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে নজরদারি ও অভিযান বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
শেয়ার করুন