আগের দিনে খেলাধুলা ছিল ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা প্রকাশের চমৎকার এক মাধ্যম। দীর্ঘ চর্চা ও কার্যকর নানা কৌশল রপ্ত করার মাধ্যমে একজন খেলোয়াড় সহজেই অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারত।
তাছাড়া শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্যও এটা খুব উপকারী। এমনকি খেলাধুলা ছিল সংশ্লিষ্টদের জন্য নির্মল বিনোদনের এক উৎস। ফলে খেলাধুলার প্রতি সমাজে মোটের ওপর ইতিবাচক মনোভাব ছিল। কিন্তু বর্তমানের স্পোর্টস ও গেমস বিষয়েও কি আমরা একই রকম মানসিকতা লালন করি? খুব সম্ভবত, না।
প্রাচীনকালে খেলাধুলা ছিল পুরোপুরি শারীরিক কসরতসংক্রান্ত। নিত্যদিন যে কাজগুলো করতে হতো সেগুলো কে সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারে তা নির্ণয়ে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উদ্ভব হয়। যেমন হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ থেকে জীবনরক্ষার তাগিদ থেকেই আদিকালের মানবেরা তীব্র গতিতে দৌড়াতে শিখেছিল। হয়তো সে কারণেই পরবর্তীকালে নানারকম ‘দৌড়’ প্রতিযোগিতা চালু হয়েছিল।
অন্যদিকে দুজন ব্যক্তির মধ্যে যে কৌশলে অন্যজনকে মাটিতে ফেলে দিতে পারত তাকে বিজয়ী কুস্তিগির মনে করা হতো। অন্যের আকস্মিক আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে প্রচলন হয়েছিল বক্সিং খেলার। লাফিয়ে দীর্ঘ জলাশয় বা উঁচু ঢিবি পার হওয়ার দক্ষতা থেকেই আবির্ভাব ঘটেছিল লংজাম্প ও হাইজাম্পের মতো খেলা। প্রত্যেক গোত্রের সুঠাম দেহের অধিকারী ও কৌশলী ব্যক্তিরাই তাদের ‘বীরপুরুষ’ বলে গণ্য হতো।
এভাবেই হয়তো দূরবর্তী স্থানে পাথর (বা গোলক), চাকতি, বর্শা ইত্যাদি নিক্ষেপ করার চর্চা শুরু হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো সেগুলোর প্রতিটি দক্ষতাই ছিল হয় নিজের জীবন রক্ষা নইলে রুটি-রুজি অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে খেলোয়াড়দের নিজ নিজ গোত্রের সদস্যরা অতি শ্রদ্ধার চোখে দেখত, আইডল মনে করত। সবাই তাদের মতো হতে চাইত, সমীহ করত।
ছুটে চলা হরিণ বা খরগোশকে বর্শার ডগায় গেঁথে ফেলা কিংবা হিংস্র প্রাণী আক্রমণকালে ছোট্ট এক চাকুর সাহায্যে তাকে হত্যা করা ছিল বীরত্বের নির্দেশক। এমনকি যুদ্ধ জয়ের উপাদানও কালক্রমে খেলার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। যেমন—তরবারি চালনা, বল্লম নিক্ষেপ, ঘোড় দৌড়, তীর চালনা, লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো প্রাচীনকালের প্রতিটি খেলায় ন্যূনতম সহায়ক উপাদান দরকার হতো। অর্থাৎ বহু ক্ষেত্রে খেলোয়াড় সশরীরে হাজির থাকাই যথেষ্ট ছিল। যদি সহায়ক কিছু দরকার হতো তবে সেটাও (পাথর, লাঠি, তীর-ধনুক প্রভৃতি) হাতের নাগালে পাওয়া যেত।
তখনকার বীরেরা সামান্য হাতিয়ার নিয়ে বাঘ-সিংহের সামনে দাঁড়াতেও ভয় করত না। হলিউডের বিখ্যাত ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ মুভিতে রয়েছে যার দারুণ উপস্থাপনা। প্রাচীন অলিম্পিকের ইভেন্টগুলো থেকেও তার দৃষ্টান্ত মেলে। সেখানে খেলোয়াড়েরা পাঁচটি ক্যাটাগরিতে (দৌড়, উচ্চলম্ফ, বল্লম নিক্ষেপ, চাকতি নিক্ষেপ ও কুস্তি খেলা) প্রতিযোগিতায় অংশ নিত।
পরবর্তী সময়ে উদ্ভব হওয়া আমজনতার খেলাগুলোয় সামান্য কিছু উপাদান যুক্ত হয়। যেমন একটা মাত্র ফুটবল দিয়ে ২২ জন খেলা যায়। এভাবে বাস্কেটবল, ভলিবল, হ্যান্ডবল ইত্যাদিতেও খুব একটা উপকরণ দরকার হতো না। কিন্তু দিন যত সামনের দিকে গড়াতে থাকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে খেলায় অন্যান্য উপকরণ ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ে।
প্রথমে এই নজর ছিল শুধু খেলার উপকরণের দিকে। তার পর পোশাক-আশাককে খেলার অবিচ্ছেদ্য অংশ করে ফেলা হয়। সঙ্গে যোগ হয় নানা ভোগ্য ও বিনোদন উপকরণ। এভাবে আওতা প্রসারিত হতে হতে এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, খেলার সাথে দূরতম সম্পর্ক না থাকা ব্যক্তিরাও এরদ্বারা প্রভাবিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে!
একটু খেয়াল করলে দেখবেন, আজকাল খেলাগুলোয় প্রচুর পরিমাণে পরোক্ষ উপকরণ ব্যবহৃত হয়। এই ধারা প্রচলনের মাধ্যমে ক্রীড়া উপকরণ ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অসংখ্য পক্ষ সুবিধা পেতে শুরু করেছে। ক্রমেই তার আওতা বাড়ছে। খেলোয়াড়দের বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান, গণমাধ্যমে তাদের তারকা ইমেজ সৃষ্টি, খেলাকে কেন্দ্র করে বড় মাপের ইভেন্ট আয়োজন ইত্যাদির মাধ্যমে আসলে এই প্রক্রিয়ায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে ভেড়ানোর চেষ্টা চলছে।
এ অবস্থায় খেলাটা আর সাধারণ মানুষের নিছক বিনোদনের ব্যাপার থাকে না। বরং এটা বড় এক বাণিজ্যিক হাতিয়ারে পরিণত হয়। তার সহজ উদাহরণ হলো ক্রিকেটের সাম্প্রতিক কোনো টুর্নামেন্ট যে পরিমাণ অর্থের হাতবদল হয় তার ঠিক কতটা শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা আর কতটা বাণিজ্যিক স্বার্থদ্বারা প্রভাবিত তা সচেতন ব্যক্তিদের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
ছোটবেলায় ভাবতাম বড় কোম্পানিগুলো খেলার আসরে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ স্পন্সর করে কেন? বিশেষত ক্রিকেট বিশ্বকাপ আসরে টাইটেল স্পন্সর করত এক সিগারেট কোম্পানি! পরে বুঝলাম যত বড় আয়োজন তত বেশি মানুষের ইনভলভমেন্ট, তত বেশি মুনাফা! হয়ত সে কারণেই আজকাল বিপিএল, আইপিএলের মতো বড় ইভেন্টগুলোয় শুধু পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান নয় বরং জুয়াড়িরাও বড় স্টেকহোল্ডার বলে গণ্য হয়।
তাদের প্ররোচনায় সারা দিন রিকশা চালানো নিরীহ লোকটা বড় লাভের আশায় বেটিং করছে। মানুষের পকেট থেকে টাকা চুষে নেয়ার জন্য এখন খেলাকে বিশেষভাবে নানা পক্ষ ব্যবহার করছে। ফলে নিরীহ খেলাধুলা আর শুধু বিনোদন বা ক্রীড়ানৈপুণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। যে ছেলেটা জীবনে একটা বল ছুড়েনি বা এক ওভার ব্যাট করেনি সেও কোম্পানিগুলোর আয়ের উৎসে পরিণত হচ্ছে।
এই প্রবণতা এতটাই বেড়েছে, খেলোয়াড়, ক্রীড়া ব্যবস্থাপক, ক্রীড়া সংস্থা ও টুর্নামেন্ট আয়োজনকারীদের হাতে এখন অনেক কিছুই থাকছে না। তাদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার বাইরেও বহু কিছু হজম করতে হয়। এভাবে খেলাধুলার ইভেন্ট আয়োজনের সময় বহু পক্ষের বাণিজ্যিক স্বার্থ মুখ্য হয়ে ওঠে। বাহ্যিকভাবে বিভিন্ন ব্র্যান্ড প্রমোটার ও পর্দার আড়ালে জুয়াড়িরা নিয়ন্ত্রণ নেয়।
ফলে বহু টুর্নামেন্টই এখন সেভাবে জমে না। তার পরও মাসের পর মাস সেগুলোর খেলা চলে। অন্যদিকে ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখতে গিয়ে অনেক সময় খেলোয়াড়দের জাস্ট নাটক-সিনেমার শিল্পীদের মতো পারফর্ম করতে হয়। শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার চেয়ে সিস্টেমের পুতুলে পরিণত হওয়া অনিবার্য হয়ে ওঠে।
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, প্রাচীনকালের যে খেলাগুলোয় শারীরিক ও মানসিক শ্রমের ব্যাপার ছিল সেগুলোকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। শিশুরা যখন জাতীয় খেলা ‘কাবাডি’ পড়ে, শুনলে হাসি পায়। যে খেলা সে কাউকে খেলতে দেখে না সেটাই নাকি আমাদের জাতীয় খেলা!
ঠিক তেমনিভাবে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত খেলাগুলো দ্রুতই অচল করে দেয়া হচ্ছে। এমনকি পুরো তরুণ প্রজন্মকে অলস-অকর্মণ্য বানানোর জন্য দিন-রাত ক্রিকেট খেলা চালানো হচ্ছে। একজন মানুষ সারা দিন যদি বিনোদন নিয়ে ব্যস্ত থাকে তবে তার আসল কাজ (পড়ালেখা, চাকরি, সাংসারিক দায়িত্ব পালন) করবে কখন?
মাঝেমধ্যে ভাবি, যেসব লেখক বাস্তব কথা (নন-ফিকশন) লেখেন তাদের সাধারণত কেউ পছন্দ করে না। অন্যদিকে, যারা অবাস্তব ও নিছক কল্পনাপ্রসূত ঘটনা লেখেন সবাই তাদের বড় মাপের লেখক হিসেবে গণ্য করে। তাদের ভক্ত ও অনুরাগীরা মাঝেমধ্যে পাগলামিও করে বসে।
বইমেলায় তাদের সঙ্গে একটা অটোগ্রাফ কিংবা ফটোগ্রাফ পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সমাজের টিকে থাকা বা সমৃদ্ধির জন্য যারা নিরলস কাজ করেন তারা কখনো সেলিব্রেটি হন না!
যে ডাক্তার প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে সেবা দেন, যে ইঞ্জিনিয়ার স্বপ্নের কাঠামো নির্মাণ করেন, যে শিক্ষক মানুষ গড়েন তারা কখনো আমাদের সমাজে ‘তারকা’ বলে গণ্য হন না। বরং তাদের প্রতি ঘৃণা জাগানোর সামান্য সুযোগ পেলেই তা উসকে দেয়া হয়।
অন্যদিকে যারা কল্পিত ঘটনা কৃত্রিমভাবে উপস্থাপন করেন সেই অভিনয় শিল্পীরা, কল্পকথা শোনানো গায়কেরা, ক্ষণিকের বিনোদন দেয়া খেলোয়াড়েরা হন বড় মাপের তারকা। অনেকে অর্থ-সম্পদ অর্জনের লক্ষ্যে হয়ে ওঠেন মরিয়া। তবু তাদের সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য ভক্ত-অনুরাগীরা হন পাগলপারা!
এটা কাকতালীয় ব্যাপার নয়, বরং পরিকল্পিতভাবে বাণিজ্যিক স্বার্থ উদ্ধারে তাদের বাস্তবের চেয়ে অনেক বড় মাপের খেলোয়াড় ও শিল্পীর ইমেজ দেয়া হয়। অনেক বেশি অর্থ প্রদান করে তাদের ‘মূল্য’ বাড়ানো হয়। এভাবে তাদের প্রতি গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের আগ্রহ ক্রমেই বৃদ্ধি পায়।
ফলে তখন খেলাটা আর মুখ্য থাকে না, ব্যাকফুটে চলে যায়। তাদের ব্যক্তিত্বের চেয়ে বিজ্ঞাপন এজেন্সির প্রত্যাশা আচার-আচরণে বেশি মাত্রায় প্রতিফলিত হয়। এভাবেই খেলাটা ধুলা থেকে ছিটকে কম্পিউটার আর স্মার্টফোনের স্ক্রিনে বন্দি হয়ে যায়। কারণ সেখানে রয়েছে বাণিজ্য ও মুনাফার সরব উপস্থিতি।
এর পেছনে সহজ যুক্তি হলো খেলাই যদি স্পন্সরদের লক্ষ্য হতো তবে আমাদের জাতীয় খেলা এভাবে জাদুঘরে চলে যেত না। ফুটবলের এই চরম হতদরিদ্র দশা ফুটবলপ্রেমী জাতিকে দেখতে হতো না। স্থানীয় পর্যায়ের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোকে হারিয়ে যেতে দিতেন না।
কিন্তু এখন এক ক্রিকেটকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে গিয়ে হাজারো খেলা বিদায় নিচ্ছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো সেগুলোর নামও জানবে না। তার পরও আমরা নিজেদের ‘ক্রীড়াপ্রেমী’ বলে দাবি করছি। সত্যিই কি সেটা বুঝে করছি?
উত্তর হ্যাঁ হলে বাণিজ্যিক স্বার্থের বলি হওয়া দেশীয় খেলাগুলো সংরক্ষণে উদ্যোগী হোন, সর্বস্তরে সচেতনতা বাড়ান।
ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও ‘মস্তিষ্কের মালিকানা’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ১২ মার্চ ২০২৪।
শেয়ার করুন