উন্নয়ন ও অনিশ্চয়তার দোলাচলে মানুষ! ড. মো. আব্দুল হামিদ

মুক্তমত

 

ভার্সিটি গেটে কিছুদিন আগেও সহজে রিকশা পাওয়া যেত না। ইদানীং রিকশার সংখ্যা বেড়েছে। এক রিকশাওয়ালার কাছে কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘এলাকায় কাজকাম কম। তাই বাড়তি রোজগারের আশায় নেত্রকোনা থেকে সিলেট এসেছি।’

প্রতিদিন কেমন ইনকাম হয় জানতে চাইলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। কিছুটা থেমে বললেন, ‘আগে ২০০ টাকা আয় হলেও ১০-২০ টাকা জমান যেত। কিন্তু এখন দিনে ৭০০-৮০০ টাকা আয় করেও সংসারের টানাটানি যাচ্ছে না।’ আরো বললেন, ‘সেদিন ৬০০ টাকার বাজারসদাই করে বাড়ি ফিরলাম। সেটা দেখে বউয়ের পছন্দ হলো না!’

একজন রিকশাওয়ালার যদি ৬০০ টাকার বাজার যথেষ্ট না হয়, অন্যদের অবস্থা অনুমান করা কঠিন নয়। একসময় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অপ্রত্যাশিত মূল্যবৃদ্ধিতে বেশ হইচই হতো। সংবাদপত্র-টেলিভিশনের শিরোনাম হওয়ার পাশাপাশি মধ্যরাতে টক শো জমে উঠত। কিন্তু এখন দেশ-বিদেশে অহরহ সংবাদের নতুন আইটেম মিলছে। এমন পরিস্থিতিতে ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি’র পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে কারই বা ভালো লাগে।

হয়তো সে কারণেই নিত্যদিন হু হু করে বাড়তে থাকা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য জিনিসপত্রের উচ্চমূল্য নিয়ে খুব একটা কথা হয় না। বরং সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা হলেও মূল্য কারসাজির হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নানা রকম ‘টোটকা’ বিতরণ করা হয়!

প্রতিনিয়ত অর্থের ক্রয়ক্ষমতা যে হারে কমছে তা নীতিনির্ধারকদের স্পর্শ করছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এটা এরই মধ্যে উদ্বিগ্ন হওয়ার পর্যায় ছাড়িয়ে গেছে। ডলার সংকট বা আন্তর্জাতিক চড়া দামের কারণে আমদানীকৃত পণ্যের মূল্য বাড়লে সেটাও না হয় মানা যেত। কিন্তু যে আলু, পেঁয়াজ, ডিম, কাঁচামরিচের সিংহভাগ দেশে উৎপন্ন হয় সেগুলোর দাম কেন আকাশচুম্বী হবে তা বোধগম্য নয়।

তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অফ-সিজনে (বছরে দু-একবার) সাময়িক সংকট হতে পারে। কিন্তু কয়দিন পর পরই এমন মূল্যবৃদ্ধির রহস্য কী? খুব সম্ভবত এর পেছনের কুশীলবরা এটা নিশ্চিত হয়েছেন যে কোনো জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের পিঠ ক্রমেই দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে, উত্তরণের পথ নেই জানা।

মানুষ স্বল্পকালীন সংকট কোনো রকমে ম্যানেজ করে। আর কয়টা দিন কষ্ট করলেই অমানিশা কেটে যাবে, এমন ভাবনা তাদের সাহস জোগায়। কিন্তু বর্তমানে তেমন আশার আলো ক্রমেই নিষ্প্রভ হচ্ছে। সঙ্গে অর্থনীতির মূল উৎসগুলো ঝুঁকিতে পড়ায় উদ্বেগ বাড়ছে। গত সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে করোনার প্রথম ধাক্কায় সবকিছু বন্ধ হলে (এপ্রিল ২০২০) এতটা কম রেমিট্যান্স এসেছিল।

আপাতদৃষ্টে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অর্থনীতি কভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এমনকি হতদরিদ্র দশা থেকে শ্রীলংকা ও কিছু ক্ষেত্রে আফগানিস্তান কামব্যাক করেছে। ঠিক সেই সময়ে আমাদের রেমিট্যান্সের করুণ চিত্র কি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়?

অন্যদিকে, জাতীয় রফতানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক শিল্পে বড় সংকটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান সুদৃঢ় করতে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড যখন সচেষ্ট রয়েছে ঠিক তখনই এ খাত সম্পর্কে দুটো বড় অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি আমাদের তৈরি পোশাকের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বলা হচ্ছে, ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতাদের নাকি নকল ও নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে! পাশাপাশি শ্রমিকদের অধিকার ও ন্যূনতম মজুরির বিষয়গুলো আবার নতুন করে আলোচনায় আসছে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় পড়ার ভয়ে নাকি বহু গার্মেন্ট মালিক তটস্থ রয়েছেন।

তিলে তিলে গড়ে ওঠা দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতের জন্য এমন সংবাদগুলো মোটেই কল্যাণকর নয়। কারণ একটা ব্র্যান্ড গড়তে যুগের পর যুগ সময় লাগে। চার দশকের বেশি সময় ধরে আমাদের গার্মেন্ট সেক্টর সেটা করতে সক্ষম হয়েছে।

কিন্তু এখন নানা অজুহাতে তার ওপর সরাসরি আঘাত এলে দেশের অর্থনীতির জন্য তা অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে। এ খাতে বিপর্যয় এলে দুই মিলিয়নের বেশি শ্রমিক সহসাই কাজ হারাবে, বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেই ভার আমরা বইতে পারব তো?

আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে ডেঙ্গুর আগ্রাসন মোটেই উপেক্ষা করার মতো নয়। কারণ ডেঙ্গুতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার বিরাজ করছে বাংলাদেশে! অথচ এত বড় সমস্যাও রাজনৈতিক ডামাডোলে আমাদের বেশ গা সওয়া হয়ে গেছে।

সংবাদপত্রগুলো এখনো কিছুটা জায়গা বরাদ্দ রাখে বলে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যাটা জানতে পারি। কিন্তু যার যায়, সেই জানে এর আঘাত কতটা প্রবল। ডেঙ্গুর টিকা থাকলে হয়তো আমরা অনেক বেশি আগ্রহী হতাম। সেগুলোর আমদানি ও প্রয়োগে বিশেষ উদ্যোগ লক্ষ করা যেত। সম্প্রতি অবশ্য সে আলাপ শুরু হয়েছে।

টানা কয়েক মাস চরম তাপপ্রবাহের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ভোগ করতে হয়েছে তীব্র লোডশেডিং। দিনে রাতে বারবার বিদ্যুতের যাতায়াতে জনজীবন ছিল অতিষ্ঠ। তাতে স্বস্তির কারণ হতে পারত বহুল প্রত্যাশিত বৃষ্টি। কিন্তু অধিকাংশ শহরে বৃষ্টির পরে জনগণের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে খোদ রাজধানীতে চরম জলাবদ্ধতায় সর্বস্তরের মানুষ নাকাল হয়েছে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর (গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ) অবস্থাও তথৈবচ।

লক্ষণীয় ব্যাপার হলো রাজশাহীর মতো (বসবাসের জন্য দেশ সেরা) শহরেও উৎসুক জনতা জাল দিয়ে রাস্তায় মাছ ধরতে নেমেছিল! এক রাতের বৃষ্টিতে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাঁটু পানি জমেছে। তার আগে চট্টগ্রাম শহর তো এ কারণে দীর্ঘদিন সংবাদপত্রের শিরোনামে ছিল।

দেশে গত তিন মাসে ছয়বার ভূমিকম্প হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা বড় ভূমিকম্পের আগাম সংকেত। তাছাড়া প্রতি শত বছরে একটি বড় ভূমিকম্প হওয়ার নজির রয়েছে। সে হিসাবে ১৮৯৭ সালের ১২ জুন আসামে সংঘঠিত ৮ দশমিক ১ মাত্রার পর এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প না হওয়ায় তার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। অনেকে বলছেন, সত্যিই তেমনটা ঘটলে সিলেট ও ঢাকা অঞ্চল বড় ক্ষতির মধ্যে পড়বে।

সামান্য জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছি না। তাহলে সত্যিই তেমন বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে কারা এগিয়ে আসবে? তাদের উদ্ধার বা প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়ার মতো ন্যূনতম প্রস্তুতিও কি আমাদের রয়েছে? সাম্প্রতিক কালে হাইতি, তুরস্ক, মরক্কো, চীন ও আফগানিস্তানের ভূমিকম্প আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, এমন দুর্যোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা আকস্মিক কতটা অসহায় হয়ে পড়ে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলার সংকট, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের আমদানি কমে যাওয়া, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া, প্রায় সর্বক্ষেত্রে সুদ-ঘুস-দুর্নীতির বিস্তার জনমনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। অর্থনৈতিক (সম্ভাব্য) নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিও সংশ্লিষ্টদের ভাবাচ্ছে।

আজকাল সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ২০২১ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন গড়ে ২২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। পরের বছর অবশ্য এ সংখ্যা ৩০ শতাংশ বেড়েছে! আমরা নিয়তি ভেবে সেগুলো মেনে নিচ্ছি।

প্রায় প্রতিটি শহরে যানজট প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজধানীতে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩২ লাখ শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। এতে দিনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা! আর যানজটে জ্বালানি পোড়ে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার (প্রথম আলো, ৬ মে ২০২৩)!

বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলার হয়েছে। প্রবৃদ্ধির বর্তমান হার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। দেশে স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, কর্ণফুলী টানেল শিগগিরই উদ্বোধন হবে, মেট্রোরেল আংশিক চলছে, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর নির্মাণাধীন রয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে অসংখ্য উড়াল সড়ক চালু হয়েছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। লক্ষ ও হাজার কোটি টাকার অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। দেশের সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। দেশে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বেড়েছে। বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করার মতো বেশকিছু কোম্পানিও গড়ে উঠেছে।

এ প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে হাঁটছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান। কিন্তু ‘উন্নয়ন’ ধারণাটির কেন্দ্রে রয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। শুধু সংখ্যা দিয়ে উন্নয়ন বুঝলে চলে না। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ কেমন আছে তা দিয়েই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন মাপা হয়। সে হিসাবে আমরা ঠিক কতটা এগোলাম তা অনুভব ও উপলব্ধি করার সময় এসেছে।

সামগ্রিক অবস্থা দেখে মনে হয় আজ বুঝি পৃথিবীর মন ভালো নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগেও হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এর তীব্রতা ও ফ্রিকোয়েন্সি এতটা বেড়েছে যে বড় ভয় হয়। আকস্মিক বন্যায় বিশ্বের নানা অঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে। এমনকি নিউইয়র্ক শহরও রক্ষা পাচ্ছে না। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সিকিম রাজ্যে ভূমিধসে পুরো গ্রাম কাদামাটির নিচে চাপা পড়েছে।

খরা, দাবানল, তাপপ্রবাহ, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত আকস্মিক আঘাত হানছে। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামীতে আমাদের দেশের ৪২ শতাংশ পর্যন্ত ভূখণ্ড পানিতে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে!

এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট সংকট। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝেই বিশ্বের নানা প্রান্ত অস্থির হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করেই বিশ্ব দেখল ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ভয়াবহ যুদ্ধের ঘটনা। আপাতদৃষ্টে ইসরায়েল হতবিহ্বল হলেও তাদের বন্ধুরা দ্রুতই এগিয়ে যাবে এবং সীমাহীন সংঘাতের সৃষ্টি হবে। এভাবে পুরো বিশ্ব অস্থির হয়ে উঠছে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যেক দেশকে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় সর্বোচ্চ তৎপর হতে হবে। নিজেরা বিভেদ সৃষ্টি করে অন্যদের দ্বারস্থ হলে স্বদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। আমরা ক্রমেই বুঝি তেমন সমস্যার গভীরে যাচ্ছি। তাই হানাহানি বন্ধ করে সংশ্লিষ্টদের দেশ ও জনগণের কল্যাণের পথে হাঁটতে হবে। নইলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে তো?

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘সুখের অসুখ’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ১০ অক্টোবর ২০২৩।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *