এক নগর, দুই মেয়র: তবু ‘অভিভাবকহীন’ সিলেট!

সিলেট

আগামী নভেম্বর পর্যন্ত সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্বে থাকছেন আরিফুল হক চৌধুরী। এরপর থেকে নগরের দায়িত্ব দায়িত্ব নেবেন মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এরইমধ্যে শপথও নিয়েছেন তিনি। তবে নিয়ম অনুযায়ী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই দায়িত্বে থাকছেন মেয়র আরিফ।

সিলেট মহানগরে মেয়র এখন দুজন। একজন দায়িত্বে, অন্যজন শপথ নেওয়া। এক নগরে দুই মেয়র, অথচ নগরবাসীর ভোগান্তি বাড়ছে বৈ কমছে না!

নগরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, এক মেয়রের বিদায় আর আরেক মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের মাঝখানের এ সময়ে অনেকটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে নগর ভবন। দায়িত্বে থাকলেও মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। নিয়মিত অফিস করছেন না। অফিস আসছেন না কাউন্সিলররাও। এ ছাড়া নগর ভবনের কর্মকর্তারাও রুটিন কার্যক্রমের বাইরে তেমন কিছু করছেন না।

গত ২১ জুন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, তবে এ নির্বাচনে দলীয় নির্দেশনা মেনে প্রার্থী হননি বর্তমান মেয়র ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী। নির্বাচনের পর থেকেই অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন তিনি।

সিটি করপোরেশনের স্বাভাবিক কার্যক্রমের চাইতে এখন দলীয় কার্যক্রমেই বেশি সময় দিচ্ছেন আরিফুল হক। নিষ্ক্রিয়তা দেখা দিয়েছে বর্তমান কাউন্সিলরদের মধ্যেও। বিশেষত, যেসব কাউন্সিলর সর্বশেষ নির্বাচনে প্রার্থী হননি বা পরাজিত হয়েছেন, তাদের এলাকাতেই পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

মেয়র ও কাউন্সিলরদের হঠাৎই নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ায় দেখা দিচ্ছে স্থবিরতা, বাড়ছে ভোগান্তি।

গত ২ জুলাই ভারি বৃষ্টিতে সিলেট নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে তলিয়ে যায় নগরের বেশির ভাগ এলাকা। অন্যান্য বছর জলাবদ্ধতা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে সিটি করপোরেশনের কর্মীদের জলাবদ্ধ এলাকা পরিদর্শন এবং পানি দ্রুত নিষ্কাশনের উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে।

এবার সপ্তাহখানেকের মতো জলাবদ্ধতা দেখা দিলেও মেয়র আরিফকে কোথাও দেখা যায়নি। পানি নিষ্কাশনে সিটি করপোরেশনেরও উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ ছিল না।

জুন ও জুলাইয়ে দুই দফায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয় সিলেট উপশহর এলাকার।

ওই এলাকার বাসিন্দা সুহেল আহমদ বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই আমাদের বাসায় পানি ঢুকে পড়ে। আগে তবু মেয়র-কাউন্সিলররা খোঁজ নিতেন। সিটি করপোরেশনের কর্মীরা এসে নালা-ড্রেনে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাত। এবার কাউকেই দেখা যায়নি। মনে হচ্ছে পুরো নগর যেন অভিভাবকহীন অবস্থায় আছে।’

সিলেট নগরে খাবার পানি সরবরাহ করে সিটি করপোরেশন। নগরের কাজীটুলা এলাকার বাসিন্দা সায়েদ আহমদ অভিযোগ করেন, ‘আগে দিনে দুবার খাবার পানি সরবরাহ করা হতো, কিন্তু নির্বাচনের পর একবারও পানি পাই না। সিটি করপোরেশনে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। সবাই এখন দায়সারা অবস্থায় আছে।’

টানা দুই বছর মেয়রের দায়িত্ব পালনকালে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে নানা উদ্যোগ নেন আরিফুল হক চৌধুরী। হকারদের পুনর্বাসন করে লালদিঘির পাড়ে অস্থায়ী মার্কেটও করে দেন। এতে ফুটপাত হকারমুক্ত না হলেও তাদের উচ্ছেদে নিয়মিতই অভিযান চালানো হত। গত দুই মাস ধরে বন্ধ রয়েছে এ কার্যক্রম।

ফুটপাত ছাড়িয়ে নগরের সড়কের অনেকাংশও দখল করে নিয়েছেন হকাররা। এতে ফুটপাত দিয়ে হাঁটার আর সুযোগ মিলছে না। সড়কে যান চলাচলও ব্যাহত হচ্ছে।

নগরের জিন্দাবাজার এলাকার ব্যবসায়ী আহসান রাসেল বলেন, ‘ফুটপাত ছাপিয়ে এখন সড়কও হকারদের দখলে চলে গেছে। আমরা দোকান ভাড়া দিয়ে, ট্রেড লাইসেন্স করে ব্যবসা করি। অথচ তাদের এসব কিছুই লাগে না।

‘খোলা জায়গা পেলেই বসে পড়ে। আর ফুটপাত দিয়ে তো এখন হাঁটার কোনো উপায় নেই। এসব দেখারও কেউ নেই।’

যানজট নিরসনে বারুতখানা-জল্লারপাড় ও কোর্টপয়েন্ট-চৌহাট্টা সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করেছিলেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এসব সড়কে যাতে রিকশা প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য মোড়ে মোড়ে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা নজরদারি করতেন, তবে নির্বাচনের আগে থেকেই এসব সড়কে অবাধে চলাচল করছে রিকশা। রিকশা নিয়ন্ত্রণে করপোরেশনের কর্মীদেরও এখন সড়কে দেখা যায় না। ফলে এসব সড়কে যানজট আরও বেড়েছে।

নগরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার সড়কগুলোও ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এগুলো সংস্কার হচ্ছে না। এ ছাড়া জন্মনিবন্ধন, মৃত্যুসনদ, ট্র্রেড লাইসেন্সের মতো জরুরি সেবা পেতেও এখন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।

সিটি করপোরেশনের ঠিক সামনের রাস্তা এবং হাসান মার্কেটের অর্ধেকের বেশি জায়গা দখল করে রেখেছেন হকাররা। তাদেরকে সরিয়ে পথচারী ও যান চলাচলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যেহেতু আমি বিএনপির একজন কর্মী এবং দল এখন এক দফা দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে, তাই আমিও এখন দলে সময় দিচ্ছি। আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছি, তবে এতে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না।’

নবনির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘শপথ নিলেও আমি দায়িত্ব গ্রহণ করিনি, তবুও নগরবাসীর সমস্যা-দুর্ভোগের কথা শুনছি। দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব সমস্যা সমাধানে পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *