সবারই শেষ গন্তব্য রাজনীতি! -ড. মো. আব্দুল হামিদ

মুক্তমত

 

ভেবেছেন কখনো, আমাদের কৃতী লোকেরা কেন নোবেল পুরস্কার পায় না? কিংবা অলিম্পিক গেমস, অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব বা পুলিৎজার মঞ্চে তাদের সগৌরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না?

নিশ্চয়ই অনেক কারণ রয়েছে। তবে অন্যতম হতে পারে, আমাদের অধিকাংশ মানুষ যে কাজটি করতে সত্যিই পছন্দ করে, বাস্তব জীবনে তা করার সুযোগ পায় না! অর্থাৎ তাদের প্যাশন ও প্রফেশন একই বিন্দুতে মেলে না। ফলে কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নেয়ার মতো অনেককে পাওয়া গেলেও শীর্ষ পারফরম্যান্স করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যায় না।

দুটো উদাহরণ দেখি। ধরা যাক, একটা ছেলে ক্রিকেট খেলার জন্য পাগল। শুধু ক্রিকেটে মনোনিবেশ করতে দিলে সে দিবারাত্রি সেটা নিয়ে মত্ত থাকত। কীভাবে নিজের সেরাটা দেয়া যায় তা নিয়ে নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করত। কিন্তু মা-বাবা তাকে প্রতিনিয়ত পুশ করতে থাকে ভালো রেজাল্ট করার জন্য।

অথচ তার মন তো পড়ে থাকে ক্রিকেটাঙ্গনে। ফলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে দীর্ঘক্ষণ বইপত্র নিয়ে বসে থাকে। ক্রিকেটে মনোনিবেশ ও চর্চার সুযোগ সেভাবে পায় না। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় তার পড়ালেখাও ভালো হয় না, ক্রিকেটেও শীর্ষস্থান দখল করতে পারে না।

আবার যে মেয়েটা সংগীত চর্চা করতে খুব ভালোবাসে, ধ্যান-জ্ঞান সব ঢেলে দিয়ে সেটাতে ভালো করতে চায়। তার মা-বাবার চিন্তা হলো ওসব করে তো পেটের ভাত হবে না। আয়-ইনকামের গ্যারান্টি নেই, পেশা হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি নেই। তাই বাধ্য হয়ে তাকে প্রতিনিয়ত একটা চাকরির জন্য পড়াশোনা করতে হয়।

পরিশেষে কোনো রকমে একটা চাকরিবাকরি করে জীবন পার হয়। পেশাগত ও সাংসারিক চাপে নিজের শখের চর্চাটি কখন যে জীবন থেকে বিদায় নেয় তা খেয়াল করার ফুরসত থাকে না।

তাছাড়া ‘বাই চান্স’ কেউ একটা পেশায় এলে সেটার প্রতি তার ন্যূনতম কমিটমেন্ট থাকে না। চাকরি রক্ষার জন্য যেটুকু দরকার জাস্ট সেটুকু করতে সচেষ্ট থাকে। এটা অনেকটা একজনের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা হওয়ার পরে অন্যের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার দশা।

এমন পরিস্থিতিতে আন্তরিকতা বা ভালোবাসার চেয়ে ‘সামাজিক প্রয়োজন’ বড় হয়ে দেখা দেয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে জীবনকে কোনো রকমে টেনে নেয়ার প্রবণতা বাড়ে। ফলে সুযোগ পেলেই সেখান থেকে সটকে পড়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হতে থাকে। বর্তমানে দেশের সব অঙ্গন থেকে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ কি তেমন কিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছে?

ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার্থী হিসেবে অবশ্য বিষয়টায় আমি অন্য এক আঙ্গিক খুঁজে পাই। সেটা হলো এখন বিশ্বব্যাপী একক আধিপত্যের জোয়ার বইছে। প্রায় প্রত্যেকটা খাতে একেকটা জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হচ্ছে। তারা এতই শক্তিধর হয়ে উঠছে যে তাদের ধারেকাছে নাম নেয়ার মতো বিকল্প কেউ থাকছে না।

বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দামি পাঁচটি ব্র্যান্ডের (অ্যাপল, গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন ও ম্যাকডোনাল্ডস) কথা ভাবুন। আপনাকে যদি এ ব্র্যান্ডগুলোর বিকল্প আরেকটি করে নাম জিজ্ঞাসা করা হয় তাৎক্ষণিক বলতে পারবেন? খুব সম্ভবত না। তার মানে কী?

মানে খুব সহজ। শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। তাদের একচেটিয়া দাপট অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে ‘মাৎস্যন্যায়’ নীতির প্রয়োগে তারা মোটেই কুণ্ঠাবোধ করে না। ক্রমেই তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঊর্ধ্বে উঠে যাচ্ছে। ধারেকাছে নাম নেয়ার মতো প্রতিযোগী ব্র্যান্ড থাকছে না।

প্রযুক্তিপণ্যের ক্ষেত্রে ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ বা টিকটক দিয়ে বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করুন। তারা অতি সফল বিজনেস মডেল রান করাচ্ছে। অথচ তাদের প্রতিযোগীরা সেটার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না!

এটা শুধু ব্যবসাজগৎ বা পারসোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রেই নয়। বরং আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রেই এমন ধারা কাজ করছে। সব পেশার মানুষের বানের জলের মতো রাজনীতিমুখী হওয়া বুঝি তারই লক্ষণ।

এটা বোঝার আরেকটা সহজ উপায় হলো দেশে ৩০ লক্ষাধিক শিক্ষিত বেকার রয়েছে। কিন্তু তাদের প্রায় সবার স্বপ্ন একটাই। সেটা হলো বিসিএস! এক অনুজ নিজ বিভাগে ঈর্ষণীয় রেজাল্ট ও নিজস্ব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা করা সত্ত্বেও সবাই তাকে নসিহত করত, তুমি বিসিএস দাও। তখন তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে পত্রিকায় এক নিবন্ধ লিখেছিলেন, সবাইকে কেন বিসিএস দিতে হবে?

সম্প্রতি নানা গোষ্ঠীর মানুষের রাজনীতিতে আগমনপ্রবণতা দেখে একই জাতীয় প্রশ্ন মনে জাগছে—সবাইকে কেন রাজনীতি করতে হবে? তাহলে কি তারা যে পেশায় জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছেন বা বিনিয়োগ করেছেন, নাম-যশ-খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করেছেন, সেখানে তারা তৃপ্ত নন? নাকি সেসব খাতের চেয়েও রাজনীতিতে বেশি কিছু অর্জনের সুযোগ দেখছেন?

এমনটা ভাবার কারণ হলো দেশসেরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যার ১ মিনিটের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য রোগীরা মাসের পর মাস অপেক্ষা করে। তিনি সেই সেবার চেয়ে এলাকার ভোটারদের সেবা করাকে অগ্রাধিকার দিলেন। এ যেন জাতীয়ভাবে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির স্থানীয় বা আঞ্চলিক হয়ে ওঠার চেষ্টা!

আরেকজন ক্রিকেটের অলরাউন্ডার। সেটা শুধু দেশের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, বিশ্বমানেও শীর্ষস্থানীয়। ব্যক্তি হিসেবে অনেকে তাকে অপছন্দ করলেও পারফরম্যান্সের কারণে তার বিরোধিতা করার সুযোগ কম। দুনিয়ার সেরা ক্রিকেটসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ।

সেটাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের অনন্য এক অবস্থান তৈরির চেয়ে ভিলেজ পলিটিকসকে তিনি বেছে নিলেন। ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতেও পারলেন না। এখনই তাকে ‘জনসেবা’য় মনোনিবেশ করতে হবে!

আরেকজন হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মুগ্ধ করেছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকে যখন একটি ভালো চরিত্রের জন্য মুখিয়ে থাকে তখন তিনি ভিনদেশের চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে দাপটের সঙ্গে কাজ করেন। নিজ দেশের দর্শকরা চেনার আগেই প্রতিবেশী দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে যান।

স্বদেশেও অর্জন কম নয়। এক হালি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার রয়েছে তার ঝুড়িতে। তাকেও ক্যারিয়ারের মাঝপথে ছুটতে হলো জনসেবা করতে! অবশ্য এর বাইরেও অনেক রথী-মহারথী বহু কাঠখড় পুড়িয়ে জনসেবা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কেউবা ডামি কিংবা স্বতন্ত্র হিসেবে আপাতত জনসেবায় তৎপর রয়েছেন।

বলতে পারেন, তাতে সমস্যা কী? মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানও তো হলিউড স্টার ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি হয়েছেন সফল রাষ্ট্রনায়ক। আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার অভিনেতা থেকে পরিণত হয়েছেন রাজনৈতিক নেতায়। পাকিস্তানে বিশ্বকাপজয়ী দলনেতা ইমরান খান ক্রিকেট থেকে রাজনীতির ময়দান একইভাবে চষে বেড়াচ্ছেন।

তাহলে আমার দেশের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, খেলোয়াড়, গায়িকা, নায়িকা, সাংবাদিক, অধ্যাপক, ব্যবসায়ীরা রাজনীতির খাতায় নাম লেখালে সমস্যা কোথায়? তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে যেমন কর্মদক্ষতা দেখিয়েছেন রাজনৈতিক অঙ্গনেও তেমনটা দেখাতে পারলে ভালোই হবে। দেশ ও জনগণ নানাভাবে উপকৃত হবে। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন হবে সমৃদ্ধ।

কথা সত্য, যদি বাস্তবে সেটা হয়। তবে অতীত অভিজ্ঞতা কী বলে? সহজ একটা টেস্ট হয়ে যাক। আচ্ছা, পাঁচ বছর ধরে সংসদ সদস্য রয়েছেন এমন একজন ‘শিল্পী’র নাম বলুন তো?

আমার ধারণা আপনি একজন সংগীতশিল্পীর নাম মনে করতে পেরেছেন, তাই না? কিন্তু আমি যদি সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য একজনের নাম জানতে চাই যার অভিনয় দক্ষতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ভাষাজ্ঞান, উপস্থাপনা এমনকি ব্যক্তিত্বের দিক থেকে অনেকের চেয়েই শ্রেয়। তার নামটা কি বহু কষ্টেও মনে করতে পারছেন? খুব সম্ভবত এখনো পারেননি।

তাহলে নিজ ক্ষেত্রে এত প্রতিভাধর একজন ব্যক্তির সংসদ সদস্য হিসেবে আমরা কেনো অস্তিত্ব উপলব্ধি করলাম না? এমন কৃতী ও মেধাবী মানুষও সেখানে গিয়ে নিষ্প্রভ হয়ে গেলেন কেন? আর সেটাই যদি নিয়তি তবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ব্যক্তিরা কেনইবা হাঁটছেন সেই পথে?

প্রত্যেক পেশায় সফল হতে গেলে বিশেষ কিছু গুণাবলি দরকার হয়। বর্তমানে রাজনীতিতে সক্রিয় ব্যক্তিদের আমরা অনেক সমালোচনা করি। কিন্তু তাদেরও অসংখ্য গুণাবলি রয়েছে। সে কারণেই বিপদে-আপদে মানুষ তাদের কাছে ছুটে যায়।

এলাকাবাসী বা প্রতিবেশী বিপদে পড়লে সুশীলদের হাতের কাছে পাওয়া যায় না। দিন-রাত একাকার করে দুঃসময়ে রাজনীতিবিদরাই মানুষের পাশে থাকেন। তাহলে কয়দিন আগে সেলফি তুলতে গেলে যিনি ভক্তদের প্রতি মারমুখী হয়ে উঠতেন, নানা পক্ষের সঙ্গে নিয়মিত দুর্ব্যবহার করতেন…তিনি কি রাতারাতি রাজনীতিকের বৈশিষ্ট্যগুলো রপ্ত করে ফেলবেন?

জীবনে কখনো সেই পথে হাঁটেননি, দল বা আদর্শের জন্য নেই ত্যাগ বা কষ্ট স্বীকারের ঐতিহ্য। হঠাৎ সংসদে যাওয়ার খায়েশ হলো আর কিছু ব্যক্তিকে খুশি করে টিকিট বাগিয়ে নিলেন?

এমন চর্চা চলতে থাকলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাকর্মীরা হতাশ হন। জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। এতে রাজনীতির সর্বোচ্চ থেকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত ভুল মেসেজ যায়।

দলীয় আনুগত্য, দলের জন্য ত্যাগ নয় বরং আখের গোছানোই মুখ্য হয়ে ওঠে। এতে ‘দুধের মাছি’দের আনাগোনা বাড়ে। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হয় সংশ্লিষ্ট এলাকা, জনগণ ও সর্বোপরি বাংলাদেশের। যারা এমন চর্চাকে প্রশ্রয় দেন তাদের ক্ষতিও খুব একটা কম হয় না।

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও ‘মস্তিষ্কের মালিকানা’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *