আগে ছেলের স্কুলের বেতন সশরীরে ব্যাংকে গিয়ে দিতাম। ব্যাংকের শাখা স্কুলে যাতায়াতের পথেই। ফলে ছুটির আগে মিনিট দশেক সময় বরাদ্দ রাখলেই চলত। এখন সেটা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এমএফএস) মাধ্যমে পরিশোধ করি।
সেবা প্রদানের জন্য এ মাসে তারা চার্জ কাটল ২৪ টাকা। নগরের ব্যস্ত জীবনে এ অর্থের পরিমাণ মোটেই বেশি নয়। কিন্তু একবার ভাবুন তো এভাবে জীবনকে সহজ করতে গিয়ে প্রতি মাসে অতিরিক্ত কত টাকা গুনতে হচ্ছে?
আগে মোবাইল ফোনে টাকা শেষ হলে দোকানে গিয়ে কার্ড কিনতে বা রিচার্জ করতে হতো। ফলে টাকা শেষ হওয়ার বেশ আগে থেকেই হিসাব করে কথা বলতে হতো। কম প্রয়োজনীয় কথাগুলো সাক্ষাতে বা পরে বলার জন্য বরাদ্দ থাকত।
ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ সিস্টেমের কারণেই মাঝেমধ্যে ভোগে কিছুটা বিরতি দিতে হতো। এখন প্রায় প্রত্যেকের ফোনেই রিচার্জের সুবিধা থাকায় ভোগপ্রবণতায় লাগাম টানার দরকার পড়ছে না। ফলে গোটা মাসে কিছুটা হলেও এ বাবদ ব্যয় বাড়ছে, তাই না?
আগে পরিবারের সদস্যরা বাইরে খেতে চাইলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে তবেই তা গলাধঃকরণ করতে হতো। তাই সংগত (রেডি হয়ে বাইরে যাওয়া, সবার সময় বের করা প্রভৃতি) কারণেই সেটা ঘন ঘন হতো না। কিন্তু এখন সংশ্লিষ্ট অ্যাপে ঢুকে কয়েকটা ট্যাপ বা একটা ফোনকলের মাধ্যমে রেডিমেড খাবার ঘরের দরজায় হাজির হচ্ছে।
সেগুলো কতটা স্বাস্থ্যসম্মত বা ব্যয়বহুল অনেকেই সেটা ভাবছে না। এমনকি বাসার মেহমানদারিতেও অনেকে এমন খাবার অর্ডার করছে। ফলে বাইরের খাবার কেনার ফ্রিকোয়েন্সি বেশ বেড়েছে।
আবার আগের দিনে কোনো পণ্য কেনার চিন্তা করলে তখনই সেটা কেনা যেত না। কারণ বিভিন্ন দোকান ঘুরে সেগুলো পছন্দ করা, বিকল্পগুলোর মধ্যে তুলনা করা, চূড়ান্ত ক্রয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বেশ কিছুটা সময় লাগত। সেই সময়ের মধ্যে আবার অনেকের মত পরিবর্তন হতো। কাঙ্ক্ষিত ব্র্যান্ড বা সাইজ না পাওয়ায় মাঝেমধ্যে সেটা কেনাই হতো না। ফলে ভোগের ক্ষেত্রে একধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতো।
কিন্তু এখন একটা লোভনীয় পণ্য অনলাইনে দেখামাত্রই অর্ডার করা যায়। সেখানে একবার পেমেন্ট হয়ে গেলে আর মত পরিবর্তন সহজ নয়। তাছাড়া হাতে পাওয়ার পর পণ্য পছন্দ না হলে সেটা বদলানো বেশ ঝামেলাপূর্ণ। ফলে অনেক সময়ই এমন ক্রয় অপচয় বাড়ায়।
অন্যদিকে, সুপারশপ, মেগাশপ, ডিপার্টমেন্ট স্টোরে শপিং করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার প্রবণতা বাড়ছে। জাস্ট এক কেজি ডিটারজেন্ট কিনতে সেখানে ঢুকে বের হওয়ার সময় ৩ হাজার টাকা বিল দেয়ার ঘটনা ঘটছে!
যে পণ্যের কথা কখনো ভাবেননি, ডিসপ্লেতে দেখার পরে আবেগের বশে সেটা কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন। অথবা লোভনীয় ছাড়ের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মাত্রাতিরিক্ত পণ্য কিনছেন!
তদুপরি, প্রচলিত মুদি দোকানে দর-কষাকষির সুযোগ থাকলেও ওই সব চকমকে স্টোরে লিখিত মূল্যের সঙ্গে ভ্যাট যুক্ত হয়। ফলে শুধু শপিংয়ের জায়গা সিলেকশনও আমাদের ব্যয়ে বেশ প্রভাব ফেলে।
ঠিক তেমনিভাবে সাধারণ পরিবহনের পরিবর্তে রাইড সার্ভিস, বাসায় ওয়াইফাইয়ের পাশাপাশি প্রত্যেকের ফোনে ইন্টারনেট প্যাকেজ, কেবল টিভির সংযোগের পাশাপাশি ওটিটি প্লাটফর্মের সাবস্ক্রিপশন, পেইড নিউজপেপার ফিড, কুরিয়ার-পার্সেল সার্ভিস…এমন কত যে খরচের খাত নিত্যদিন চালু হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। ফলে অন্যদের অনুকরণ করতে গিয়ে কখন যে জীবনযাপনের ব্যয় বাড়াচ্ছি তা খেয়াল করছি না।
যাদের অঢেল অর্থ রয়েছে তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু মধ্যবিত্তের এক বড় অংশ এ ধারায় তাল মেলাতে গিয়ে হিসাব মেলাতে পারছে না। প্রতি মাসে টানাটানি করে চলছে। পরবর্তী মাসে ব্যয় কমার পরিবর্তে সুবিধার মোড়কে এমন আরো একাধিক খরচের খাত যুক্ত হচ্ছে।
যেমন অনেকে বাসার এসি কেনার ক্ষেত্রে শুধু এসির দাম বিবেচনা করছে, হয়তো প্রয়োজন বিবেচনায় কিস্তিতে কিনছে। কিন্তু সেজন্য প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিলের মতো স্থায়ী খরচের খাত উন্মুক্ত হচ্ছে, সেটা আপাতত ভাবছে না।
আবার গাড়ি কেনার সময় সেটার ক্রয়মূল্য বা রেজিস্ট্রেশন খরচ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকছে। কিন্তু প্রতি মাসে সেটা সচল রাখতে গেলে ঠিক কী পরিমাণ খরচ যুক্ত হবে তা বিবেচনায় নিচ্ছে না। ভাবছে কোনোমতে একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারলেই বুঝি বিনা খরচে আজীবন থাকা যাবে। কিন্তু সত্যি কি তাই?
বরং দেখা যাচ্ছে সেটার মেইনটেন্যান্স বাবদ প্রতি মাসে আগের বাসা ভাড়ার প্রায় অর্ধেক খরচ হয়ে যাচ্ছে! এভাবে জীবনকে সহজ করতে গিয়ে কীভাবে যেন আমরা কঠিনের চক্করে পড়ে যাচ্ছি।
সুখের লাগাম ধরার জন্য একটা সময় অনেক কষ্ট করছি। কিন্তু সেটা অর্জনের পর দেখা যাচ্ছে খুব একটা লাভ হয়নি। বরং কোন কোন দিক দিয়ে যেন বিপুল পরিমাণ অর্থ বেরিয়ে গেছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় (বিশেষত তেল, পেঁয়াজ, চিনি প্রভৃতি) দ্রব্যাদি গণমাধ্যমে বেশ মনোযোগ পায়। ফলে সেগুলোর দাম নিয়ে অনেক কথা হয়। অথচ বাঙালির সবচেয়ে ভাবনার উপাদান চালের দাম নিয়ে ইদানীং খুব একটা উচ্চবাচ্য শোনা যায় না।
এর বাইরে গত এক বছরে শত শত আইটেমের দাম দেড় থেকে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে খুব একটা আলাপ হয় না। মাছ-মাংস-সবজির কথা মাঝেমধ্যে আলোচনায় আসে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কত ধরনের চার্জ বা ফি যে বেড়েছে তা কোনো কর্তৃপক্ষই খেয়াল করছে না।
যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো ফি ও চার্জ বাড়াচ্ছে, শিক্ষা উপকরণের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে, সৃজনশীল শিক্ষার নামে গাইড বই কেনা (প্রায়) বাধ্যতামূলক পর্যায়ে গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত খরচ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে, বিভিন্ন দপ্তরে সেবার চার্জ বেড়েছে, রেস্টুরেন্টে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। বাসা ভাড়া তো বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে।
বাড়ছে না শুধু সাধারণ মানুষের আয়। বরং কভিড-পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতিতে অনেকের আয় কমেছে। কেউবা কর্ম হারিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বহু মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানার দৃশ্যমান ও কার্যকর তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতে আলাপে অনেকেই জানতে চান, কীভাবে সাংসারিক ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়? এক কথায় বলা মুশকিল। প্রত্যেকের বাস্তবতা ভিন্ন। তাই নিজের ক্ষেত্রে কার্যকর পন্থা নিজেকেই ঠিক করতে হবে। তাছাড়া কঠিন সময়ে নিজেই নিজেকে রক্ষায় মনোযোগী হতে হয়। তাই নিজের অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
বাইরে ঠাট বজায় রাখতে গিয়ে ভেতরে ভেতরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কাজের কথা নয়। তাই নিচের বিষয়গুলো চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
প্রথমত, বাসায় সত্যিকারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর তালিকা করে তবে সেগুলো কিনতে যাবেন। তালিকার বাইরে হঠাৎ কিছু কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। ইমপালস গুডস হিসেবে বাদাম, চিপস, ফুসকা কেনা ঠিক থাকলেও বড় মাছ বা গরুর রান কেনা উচিত নয়।
দ্বিতীয়ত, সবসময় নগদ টাকা দিয়ে পণ্য ক্রয় করতে হবে। কার্ড বা ফোনে পেমেন্টের চেয়ে নিজের হাত দিয়ে অন্যকে টাকা দেয়া একটু হলেও কঠিন। তাছাড়া এটা হিসাব রাখার জন্যও বেশ কার্যকর।
তৃতীয়ত, বাকি খাওয়ার প্রবণতা বাদ দিতে হবে। এতে একদিকে বিক্রেতা দাম বেশি রাখে, অন্যদিকে নগদ প্রদানের গরজ না থাকায় মাত্রাতিরিক্ত ভোগের প্রবণতা বাড়ে। ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়।
এক্ষেত্রে অনেকে একটা ভুল পন্থা অবলম্বন করেন। সেটা হলো নিজের পায়ের তলার মাটি যে ক্রমেই সরে যাচ্ছে তা পরিবারের সদস্যদের বুঝতে দিতে চান না। অর্থাৎ তিনি একা লড়াই করে চলেছেন কিন্তু পরিবারের অন্যেরা আগের গতিতেই চলছে।
এভাবে সাপোর্ট দিতে গেলে একসময় পরিবারের প্রধান আর চাপ নিতে পারেন না। তখন হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের অজুহাতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়। আর হাসপাতালের বিছানায় আশ্রয় হলে সে তো আরেক বড় খরচের ব্যাপার। তাই একার লড়াইটা পরিবারের সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া জরুরি।
সুসময়ে সবাই মিলে যেমন উপভোগ করেছেন, দুঃসময়েও সেটাই করা উচিত। নইলে তাদের রক্ষার নামে আসলে আপনি তাদের ক্ষতিই করছেন। পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তিটি আকস্মিক নিশ্চল হলে বা মারা গেলে তারা আরো বড় বিপদে পড়বে। তাই শুরু থেকেই তাদের অংশীদার করুন।
অনেকে আয় বাড়িয়ে ম্যানেজ করতে চেষ্টা করেন। রেগুলার চাকরি বা ব্যবসার বাইরে আরেকটা কিছু করতে সচেষ্ট হন। উদ্দেশ্য ভালো হলেও পদ্ধতি হিসেবে এটা ভালো নয়।
কারণ দেশে বিপুলসংখ্যক বেকার লোক কাজ পাচ্ছে না। সেখানে আপনার জন্য অতিরিক্ত কাজ সহজলভ্য হবে না। তাছাড়া আপনার শরীর ও মন কতদিন এই চাপ নিতে পারবে, সেটাও ভাবা জরুরি। তাই আয়ের চেষ্টার পাশাপাশি ব্যয় কমাতে সর্বোচ্চ তৎপর হোন।
আপনার কাছে নিবন্ধের সূচনায় বর্ণিত এমএফএস ফি ২৪ টাকা নাকি ১০ মিনিট সময়—কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? যদি সময় থাকে তবে সামান্য এ অর্থ বাঁচান। কারণ বিন্দু থেকেই সিদ্ধু হয়। আবার সামান্য ছিদ্র দিয়ে সারা রাতে ভরা বালতি ফাঁকা হয়ে যায়!
কেউ কেউ সাময়িক ঋণ করে চালিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। এটাও কার্যকর পন্থা নয়। কারণ বর্তমান মাসে যদি আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয় তবে আগামী মাসে এমন কী ঘটবে যে আপনার আয় অনেক বেড়ে যাবে? অথচ ব্যয়ের পরিমাণ যে বাড়বে তা অনেকটাই নিশ্চিত।
তাছাড়া বিশ্ব পরিস্থিতি ঠিক কোন দিকে যাবে, আমাদের ওপর তার প্রভাব কেমন হবে—তা আমরা কেউ জানি না। তবে সেটা মন্দ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই এখনই নিজের প্রতি সুবিচার করুন। যেখানে যতটুকু খরচ কমানো সম্ভব সেটা করুন। এতে পরিবারের সদস্যরা আপাতত অসন্তুষ্ট হলেও দীর্ঘমেয়াদে তাদের কল্যাণই হবে।
ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘সুখের অসুখ’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ১১ মে ২০২৩।
শেয়ার করুন