উসওয়াতুন হাসানাহ -মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার

মুক্তমত

 

জাহিলিয়াত যখন দুনিয়াবাসীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছিলো, ঠিক তখনই তাঁর আগমন। আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশনার আলোকে তিনি ডাকতে শুরু করলেন। পথহারা মানুষেরা ফিরে পেলো আলোর পথ। শান্তি ও মুক্তির পথ। জীবনে ফিরে পেলো স্বস্তি আর নিরাপত্তা। সেই আলোর দিশারী আর কেউ নন, তিনি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। যিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুপম আদর্শের নজির স্থাপন করে গিয়েছেন। তাঁর জীবনাদর্শই সেরা। উসওয়াতুন হাসানাহ অর্থাৎ সর্বোত্তম আদর্শ। আল্লাহ তা’য়ালা জানিয়ে দিয়েছেন: তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের (সা.) মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। [৩৩. সূরা আল-আহযাব: ২১]।

চারিত্রিক দিক থেকে অধঃপতিত মানুষগুলোকে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক মাধুর্য ও আদর্শ দিয়ে নৈতিকতার উচ্চ শিখরে আরোহনের ব্যবস্থা করে দিলেন। আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা: আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের উপর রয়েছেন। [৬৮. সূরা আল-কালাম: ৪]। হযরত আলী (রা.) বলেন: মহৎ চরিত্র বলে কুরআনের শিষ্টাচার বুঝানো হয়েছে। [কুরতুবী]। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন: মহৎ চরিত্রের অর্থ মহৎ দ্বীন। কেননা আল্লাহর কাছে ইসলাম অধিক প্রিয় কোনো দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা নেই। তিনি নিজেই বলেন: নিশ্চয়ই ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন। [৩. সূরা আলে-ইমরান : ১৯]। আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। [৩. সূরা আলে ইমরান: ৮৫]। আল্লাহর রাসুলের (সা.) নৈতিক চরিত্রের সুন্দর পরিচয় তুলে ধরেছেন হযরত আয়েশা (রা.)। তিনি বলেছেন, কুরআনই হলো তাঁর চরিত্র। [মুসনাদে আহমদ: ৬/৯১]।

হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আমি দশটি বছর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। আমার কোনো কাজ সম্পর্কে তিনি কখনো উহ! শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেন নি। আমার কোনো কাজ দেখে কখনো বলেন নি, তুমি এ কাজ করলে কেন? কিংবা কোনো কাজ না করলে কখনো বলেন নি, তুমি এ কাজ করলে না কেন? [বুখারী: ৬০৩৮; মুসলিম: ২৩০৯]। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই বলেছেন: আমি উত্তম চরিত্রকে পরিপূর্ণতা দেয়ার জন্যই প্রেরিত হয়েছি। [মুসনাদে আহমদ: ২/৩৮১]।

জাহেলী যুগে লোকেরা মিথ্যা কথায় অভ্যস্ত ছিলো। কথাবার্তায় মিথ্যা থেকে দূরে থাকতে পারতো না। মিথ্যা কথা, মিথ্যা সাক্ষী দেয়া কিংবা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে অপরাধবোধ তাদের অন্তরে লালিত হতো না। বিশ্বনবী (সা.) নিজেকে সত্যবাদী হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। জীবনে একটি বারের জন্যও তিনি মিথ্যার আশ্রয় নেন নি। তাইতো আরবের মানুষেরা তাঁকে আস-সাদিক উপাধিতে ভূষিত করেছিলো। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। [৯. সূরা : তাওবা : ১১৯]। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন: নিশ্চয়ই সত্য ভালো কাজের পথ দেখায় আর ভালো কাজ জান্নাতের পথ দেখায়। আর মানুষ সত্য কথা বলতে অভ্যস্ত হলে আল্লাহর কাছে সত্যবাদী হিসেবে (তার নাম) লিপিবদ্ধ হয়। নিশ্চয়ই অসত্য পাপের পথ দেখায় আর পাপ জাহান্নামের পথ দেখায়। কোনো ব্যক্তি মিথ্যায় রত থাকলে পরিশেষে আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী হিসেবেই (তার নাম) লিপিবদ্ধ করা হয়। [বুখারী: ৬০৯৩]।

আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর উদার চিত্ত, বিরুদ্ধবাদীদের হৃদয় ও মন জয় করার সুযোগ তৈরী করে দিতো। তায়েফে রক্তাক্ত হয়েছেন। তবুও তাদের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষ লালন করেন নি। আল্লাহর কাছে তাদের জন্য হেদায়াতের দোয়া করেছেন। মক্কার কাফির মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামদের কতো কষ্ট দিয়েছিলো। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি তাদের উদ্দেশ্যে ক্ষমার ঘোষণা জানিয়ে দিলেন। তিনি বিরোধিতা করা সত্ত্বেও অমুসলিমদের জন্য বদদোয়া না করে কল্যাণ ও হেদায়াতের জন্য দোয়া করতেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একদা আবু তোফায়েল ও তার সঙ্গীরা এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, (ইয়েমেনের) দাউস গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং কুফরি করেছে। আপনি তাদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করুন। উপস্থিত লোকরা বলতে লাগল- দাউসের লোকেরা ধ্বংস হয়ে গেছে। দাউস ধ্বংস হয়ে গেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বদদোয়া না করে তাদের জন্য দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি দাউস গোত্রের লোকদের হেদায়াত দিন এবং তাদের (আমার কাছে) এনে দিন। [বুখারী]।

আল্লাহর রাসুল (সা.) খুব সাদামাটা জীবনের অধিকারী ছিলেন। তাঁর আদর্শের অনন্য দিক ছিলো, তিনি বিনয়ী ছিলেন। যা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। হযরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে কথা বলতে এলো। তখন ভয়ে সে কাঁপছিলো। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, শান্ত হও। আমি কোনো রাজা-বাদশা নই। আমি একজন সাধারণ নারীর সন্তান। [ ইবনে মাজাহ: ৩৩১২]। হযরত আয়েশা (রা.)-কে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘরে কী করতেন? তিনি উত্তরে বললেন- তিনি পরিবারের কাজে সহযোগিতা করতেন। [সহীহ বুখারী: ৬৭৬]।

আল্লাহর রাসুলের (সা.) পুরো জীবন আমাদের জন্য উসওয়াতুন হাসানাহ অর্থাৎ সর্বোত্তম আদর্শ। অল্প কিছু দিক তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। তাঁর জীবনাদর্শ জানার জন্য হৃদয়ে ব্যাকুলতা ও আন্তরিকতা থাকা চাই। তাঁর মহব্বত ও আনুগত্যে আরও সক্রিয় হওয়া জরুরী। কথা ও কাজে তাঁর আদর্শকে আঁকড়ে ধরতে পারলে, দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তি সুনিশ্চিত; ইন শা আল্লাহ। আসুন, সেই প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখি। আল্লাহ তা’য়ালা! কবুল করুন। আমীন।

মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার, সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *