তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য ভাবনা-ড. মো. আব্দুল হামিদ

মুক্তমত

প্রত্যেক বয়সের স্বাভাবিক কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। সেগুলোর বিকাশ ও প্রকাশে এক বিশেষ সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। যেমন একটা শিশু চঞ্চল হবে, নানা বিষয়ে কৌতুহল থাকবে, অসংখ্য প্রশ্ন করবে সেটাই স্বাভাবিক। আবার একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি ধীর-স্থির হবেন, আকস্মিক বড় সিদ্ধান্ত নেবেন না সেটাই সংগত। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি প্রশ্ন করা হয়, একজন তরুণের বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী?

এমন প্রশ্নের জবাবে প্রথমেই মাথায় আসে তারুণ্যের উন্মাদনার বিষয়টি। ওই বয়সের ছেলে বা মেয়েরা সর্বদা প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর থাকবে। নির্ধারিত কাজ, পড়ালেখা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমসহ নানা বিষয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত রাখবে। যেকোনো উদ্যোগ গ্রহণে সোৎসাহে এগিয়ে আসবে। তাদের চিন্তা ও কর্মে ব্যক্তিস্বার্থের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে না। ঝুঁকি নিয়ে হলেও সত্য ও সুন্দরের পক্ষে দাঁড়াবে।

তারা পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে নেতৃত্ব দিতে উদগ্রীব থাকবে। রাজনীতিতে অতি সক্রিয় না হলেও রাজনীতি সচেতন হবে। চারপাশের মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ ভাবনা তাকে উদ্দীপ্ত করবে। প্রয়োজনে রুখে দাঁড়াবে। অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে তারা হবে সমাজের রক্ষাকবচ। শুভ ও কল্যাণের পক্ষে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে… এমন আরো কত কী?

কিন্তু ইদানীং আপনার চারপাশের তরুণদের মাঝে তেমন বৈশিষ্ট্যগুলো কি দেখতে পাচ্ছেন? এ প্রসঙ্গে যাদের সঙ্গেই আলাপ হয় তাদের কণ্ঠে এক ধরনের হতাশার সুর ধ্বনিত হয়। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাঙ্গন, কর্মক্ষেত্র সবখানে তরুণদের বড় অংশকে কেমন যেন মনমরা ও উদ্যমহীন দেখায়। বাহ্যিকভাবে মনে হয় তারা যেন ভীষণ ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। অনেকের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। তাদের কথা ও কাজে এক নিষ্প্রাণ ও দায়সারা উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, শিক্ষিত তরুণদের মাঝে এ প্রবণতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি!

পড়ালেখা, খেলাধুলা, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সব কিছুতেই তাদের কেমন যেন অনীহা। এমনকি শুধু নিজের ভালো লাগার জন্য আগে যেসব সৃজনশীল কাজকর্ম করা হতো এখন সেগুলোও কমে যাচ্ছে। অনেককে দেখলে মনে হয় বহু কষ্টে নিজের শরীরটাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। কোনো কিছুই তাদের উদ্দীপ্ত করতে পারছে না।

অনেকে সবসময় হতাশায় ভুগতে থাকে। তারা অন্যদের সঙ্গে মেশে না, মন খুলে কথা বলে না, এমনকি সহপাঠী বা সমবয়সীদের সঙ্গে সেভাবে আড্ডাও দেয় না! এদের কেউ কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করে থাকে। মাঝেমধ্যে দু-একজন খবরের শিরোনাম হয়। অন্যদের সেভাবে রেকর্ড থাকে না। তবে সংখ্যাটা একেবারে কম নয়। বিষয়টা কি যথেষ্ট উদ্বেগজনক নয়?

আগে বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানে এমন প্রবণতা দেখা যেত। যেমন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার চাপে প্রায় বিষণ্ন থাকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ২৪ জন মেডিকেল শিক্ষার্থী কোনো না কোনো পর্যায়ে আত্মহত্যার কথা ভেবেছে (প্রথম আলো, ৩ আগস্ট ২০২২)! তাদের বড় অংশ পরীক্ষায় খারাপ করার টেনশনে ভুগত।

এছাড়া পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, পরিবারের অতিরিক্ত প্রত্যাশা প্রভৃতি কারণ তো রয়েছেই। অন্যদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এমনটা শোনা যেত। কিন্তু এখন বিষয়টা মনে হচ্ছে সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে। বর্তমানে এটা একক কোনো গোষ্ঠী, সমাজ বা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা নয়। খুব সংগত কারণেই মনে প্রশ্ন জাগে—কেন এমনটা হচ্ছে?

নিশ্চয়ই অসংখ্য কারণ রয়েছে। তবে মোটাদাগে কয়েকটা বিষয়ে আলোকপাত করতে চেষ্টা করব। প্রথম কথা হলো, মানুষের হতাশ হওয়ার ভিত্তি হলো প্রত্যাশামাফিক ফল না পাওয়া। সেটা হতে পারে কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট, শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, স্বপ্নের চাকরিতে প্রবেশ, কিংবা পছন্দের মানুষটিকে জীবনসঙ্গী হিসেবে না পাওয়া। কেউ এমন এক বা একাধিক বিষয়ে হতাশ হলে সেটার কারণ সহজে বোঝা যায়।

কিন্তু বর্তমানে তরুণদের এক বড় অংশ ঠিক বুঝতে পারে না কেন সে বিষণ্ন থাকে! হয়তো নিজে নিজে সেখান থেকে বের হতে চেষ্টাও করে। কিন্তু পারে না। হতাশা বা বিষণ্নতার প্রকৃত কারণ জানা না থাকায় সংকট ক্রমেই প্রবল হয়। বর্তমানে এ সংখ্যাটা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

দ্বিতীয়ত, সুস্থতার ধারণাটি এখনো আমাদের অধিকাংশের কাছে শারীরিক সুস্থতার সমার্থক। অথচ কম্পিউটারের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের শরীর হলো হার্ডওয়্যার। আর যে মন এটাকে চালায় তা হচ্ছে সফটওয়্যার। সফটওয়্যার বিগড়ে গেলে লাখ টাকার কম্পিউটার যেমন অর্থহীন, আমাদের সুস্থতার ক্ষেত্রে মনের ভূমিকাও তেমন। অথচ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা এখনো আমাদের সমাজে ‘ট্যাবু’ হয়ে আছে।

এমনকি শিক্ষিত লোকদেরও মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের কাছে যেতে বললে ভাবেন তাকে পাগলের চিকিৎসা নিতে বলা হচ্ছে! সবাই কী বলবে—এটা ভেবে তারা ভয়ংকর কষ্টের মধ্য দিয়ে যান। কিন্তু সবাই তাকে ‘মানসিক রোগী’ বা পাগল বলবে এ ভয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না! তরুণদের মনেও এ ভীতি কাজ করা অস্বাভাবিক নয়। তাই তারা চিকিৎসার আওতায় আসে না; সংকট ক্রমেই বাড়তে থাকে।

তৃতীয়ত, আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষভাবে আগ্রহী। কিন্তু মেধা ও মননশীলতার বিকাশে শুধু কি আধুনিক ভবন বা প্রশস্ত রাস্তাই যথেষ্ট? তরুণদের মানসিক বিকাশে বা তাদের সংকটে পাশে দাঁড়ানোর আয়োজন কি সন্তোষজনক? এক্ষেত্রে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য বেশকিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেমন ছাত্র উপদেষ্টার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক একজন মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলর নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

তাছাড়া প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা ছাত্র উপদেষ্টা রয়েছে। আমাদের (ব্যবসায় প্রশাসন) বিভাগে প্রত্যেক সেশনে একজন করে ব্যাচ কো-অর্ডিনেটর রয়েছে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সমন্বিতভাবে সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিতে চেষ্টা করছে। অথচ দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়গুলোয় চরম উদাসীনতা রয়েছে। কিন্তু সারা দেশে তরুণদের সমস্যার ধরন তো প্রায় একই রকম। তাছাড়া আগামীতে এ সংকট আরো বাড়বে তা বলাই বাহুল্য।

চতুর্থত, মানুষ বাঁচে আশায়। আমরা পড়ালেখা করার সময় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম যে প্রয়োজনীয় মেধা ও দক্ষতা থাকলে প্রত্যাশিত পেশায় যাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ ছাত্রজীবনে কষ্ট হলেও সফলতাপূর্ণ এক জীবন সামনে অপেক্ষা করছে। চারপাশে তেমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেখতাম বলেই আমরাও সাহস পেতাম।

কিন্তু আজকের তরুণদের বড় অংশ কি তেমনটা ভাবতে পারছে? কোটি বেকারের ভিড়ে নিজের একটা সম্মানজনক জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা কি তাদের হাতছানি দেয়? উত্তর অজানা নয়। অথচ মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, এলাকাবাসী তাদের ‘মেধাবী’ বলে জানে। কিন্তু সে নিজে ক্ষীণ আশার আলোও দেখতে পায় না। সে জানে আজকের দিনে সফল হতে গেলে যে ‘বিশেষ যোগ্যতা’ লাগে সেগুলো তার নেই। ফলে হতাশা তাকে ক্রমেই গ্রাস করে। অসংখ্য নেতিবাচক খবরের ভিড়ে অনেকেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না।

পঞ্চমত, আপাতদৃষ্টে যে প্রযুক্তি আশীর্বাদ বা কল্যাণকর হতে পারত সেটাই অনেকের বড় ক্ষতির কারণ হচ্ছে। অনেক তরুণ খুব প্রয়োজন না হলে বাইরে যায় না, খেলাধুলা করে না, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয় না, পড়ালেখায় মন বসে না… তাহলে সে করবেটা কী? তাদের এসব রোগের মহৌষধ রূপে আবির্ভূত হয়েছে হাতের স্মার্টফোনটি।

ফেসবুক, ইউটিউব, ওটিটি প্লাটফর্ম, খেলা দেখা, গেমস ইত্যাদিতে দিনের সিংহভাগ সময় যাচ্ছে। তার চেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে তারা কোনো কিছুতে গভীরভাবে মনোযোগী হওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে। অনেকের ক্ষেত্রেই সেটা মাদকের চেয়েও ভয়ংকর আসক্তিতে রূপ নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে খাওয়া, ঘুম, পড়ালেখা কোনো শিডিউলই কাজ করছে না। ফলে অধিকাংশ সময় সে থাকছে ক্লান্ত ও অবসন্ন। সামনে যতক্ষণ স্ক্রিন থাকে, সবকিছু ভুলে থাকে। কোনো কিছুই তাকে ভাবায় না, সেভাবে উদ্দীপ্ত করে না।

বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বিকাশে তরুণরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বই সালের ইতিহাস সেটাই সাক্ষ্য দেয়। অর্থাৎ শিক্ষিত তরুণরা রাজনীতি সচেতন ছিল। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে তারা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দ্বিধা করত না। কিন্তু এখনকার তরুণদের প্রায় পুরোটাই রাজনীতি বিমুখ।

পদ-পদবিধারী কিছু শিক্ষার্থী সক্রিয় থাকে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতির ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী নয়। এটা কি একটা জাতির জন্য ভালো লক্ষণ? তাদের এ বিমুখতার দায় আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কি এড়াতে পারবেন? শিক্ষিত ও সচেতন তরুণরা যদি ভালোবেসে রাজনীতিতে না আসে তবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের হাল ধরবে কারা? টেকসই উন্নয়নের ধারণা তো রাজনীতিতেও চর্চা হওয়া দরকার, তাই না?

পরিশেষে বলব, বর্তমানে নানা কু-অভ্যাসকে আধুনিকতা বা স্মার্টনেস বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে, যা একজন মানুষের শরীর ও মনের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর তা আধুনিকতা হয় কেমন করে? এক্ষেত্রে এক ঘটনা বলে শেষ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আমাদের এক বন্ধু ছিল রাত ১০টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে মশারির মধ্যে ঢুকত। তার রুমমেটরা এতে খুব বিরক্ত ছিল। আমরাও তার এ ঘুমকাতুরে স্বভাবের কারণে খুব ক্ষ্যাপাতাম। আমাদের কোনো চেষ্টাই তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। পুরো হলজীবনে সে ভোরে উঠে নামাজ পড়ে, হাঁটাহাঁটি করে তবে পড়তে বসত।

তখন তাকে ক্ষ্যাত বা ব্যাকডেটেড মনে হলেও এখন দেখছি সেই ছিল সবচেয়ে বুদ্ধিমান। তার এই একটি অভ্যাস তাকে আজীবন সাহায্য করবে। কারণ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, ওই সময়ের ঘুম মানবশরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারি। সুস্থ-সবল থাকতে এমন ঘুমের বিকল্প নেই!

অথচ আমরা সারা রাত জেগে থাকা আর বেলা ১১টা পর্যন্ত ঘুমানোকে স্মার্টনেস ভাবছি, যা শরীর, মন, ক্যারিয়ার সবকিছুর জন্যই ক্ষতিকর। এমন অসংখ্য অভ্যাস ও চর্চা আমাদের তরুণদের ক্রমেই নিষ্প্রভ করছে। উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ক্ষয় হচ্ছে তাদের জীবনী শক্তি। সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই বিষয়গুলো ভেবে করণীয় ঠিক করবেন… সেটাই প্রত্যাশা।

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘মস্তিষ্কের মালিকানা’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ২৪ অক্টোবর ২০২৩।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *