সফলতার জন্য নিরলস চেষ্টা প্রয়োজন- ড. মো. আব্দুল হামিদ

মুক্তমত

মনে করুন, আপনি এক রাজার গবেষণাগারপ্রধান। একদিন রাজা আপনাকে ডেকে বেশকিছু নির্দেশনা দিলেন। মূল কথা হলো—তিনি বিশেষ এক বস্তু চান! তার কথার মাথামণ্ডু কিছুই ঠাহর করতে পারলেন না। অথচ নির্ধারিত দিনে পণ্যটি হাজির করতে হবে। রাজার সেটা মনঃপূত না হলে, নিশ্চিত গর্দান যাবে!

এ অবস্থায় (স্পষ্ট কোনো ধারণা ছাড়াই) পণ্যটি তৈরি করতে হবে, যা দেখে রাজা পুলকিত হবেন। কাজটা সত্যিই কঠিন, তাই না? সামান্য ভুলে গর্দান যাওয়ার শঙ্কা থাকলেও রাজাকে সন্তুষ্ট করা গেলে, পুরস্কার মিলবে অঢেল। তাই এক্ষেত্রে সফলতা ও ব্যর্থতা সমানমাত্রায় ক্রিয়াশীল।

একজন মার্কেটারের ক্ষেত্রেও পুরস্কার বা তিরস্কার নিত্যসঙ্গী। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে মার্কেটিং চর্চা নিয়ে অনেক কথা হয়। বহু প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে অনেকে ব্যক্তি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নিয়ে সফল হতে চেষ্টা করছেন। তাদের অনেকেই দ্রব্যের পাশাপাশি সেবাধর্মী পণ্যের মার্কেটিংয়ে সচেষ্ট। তাদের কার্যক্রম দেখেই মূলত এ নিবন্ধের ধারণাটি মাথায় আসে।

বেশ আগে শ্রদ্ধেয় এক লেখকের সাক্ষাত্কার শুনছিলাম। তিনি বললেন, প্রথম বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরির পর তার প্রিয় (সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ) একজনকে সেটা পড়তে দেন। খসড়া লেখাটি পড়ার পর অভিজ্ঞ সেই ব্যক্তি তাকে বলেন, যদি আপনি সত্যিই লেখালেখি করতে চান তবে আগামী ১০ বছর একটি লাইনও লিখবেন না। শুধু অন্যদের লেখা পড়বেন, যা পাবেন তাই পড়বেন, প্রকাশের জন্য লিখবেন না!

সেই উপদেশ পাওয়ার পর তিনি টানা ১০ বছর শুধু পড়েছেন! তারপর তিনি যে বইটি লিখেছেন তা বহুল প্রশংসিত হয়েছে। বহুদিন পরও মানুষ সেটা পড়বে। তাই যারা একটা কথা মনে উঁকি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুকে না দিলে শান্তি পান না, তাদের একটু থামতে হবে। না হলে সফলতা সোনার হরিণই রয়ে যাবে।

কোনো বিষয়ে সত্যিকারের দক্ষতা অর্জনে ঠিক কতটা সময় নিবিড় চর্চা দরকার—সে বিষয়ে আপনার কোনো ধারণা আছে? অর্থাৎ ম্যারাডোনা, পেলে, শচীন, লারা, এ আর রহমান ঠিক কত ঘণ্টা নিবিষ্ট চর্চার পর লাইমলাইটে এসেছেন? কাজের ধরনের ভিন্নতায় অবশ্যই তারতম্য হবে। তাছাড়া ব্যক্তির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার মতো অসংখ্য উপাদানের ওপর নির্ভর করে।

তবে এ ব্যাপারে ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল তার ‘আউটলায়ারস’ বইয়ে বলেছেন, অন্তত ১০ হাজার ঘণ্টা নিবিড় পরিশ্রম দরকার হয়! তার মানে প্রতিদিন ৬ ঘণ্টা করে ওই বিষয়ে কঠোর পরিশ্রম করলে টানা পাঁচ বছর লেগে থাকতে হবে! আর প্রত্যেক দিন ৪ ঘণ্টা করে হলে প্রায় ৭ বছর!

অর্থাৎ একজন ব্যক্তি পার্থক্য সৃষ্টি করার মতো চিত্রশিল্পী, সংগীত শিল্পী, খেলোয়াড়, লেখক যাই হতে চান না কেন তার অন্তত উল্লেখিত পরিমাণ সময় আন্তরিকতার সঙ্গে সেটা চর্চা করা দরকার। সে একই কথা ইউটিউবার, টিকটকার, লাইকিবাজ বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ‘তারকা’দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু অনলাইন জগতে সফলতাপ্রত্যাশী জন্মসূত্রে ‘প্রতিভাবান’দের তেমন সময় ও ধৈর্য আছে কি?

উত্তর অজানা নয়। সে কারণেই প্রতিনিয়ত প্রচুর কনটেন্ট উত্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু ঠিক তার কত ভাগ মানসম্পন্ন? সেগুলোর ভিড়ে ভালো কনটেন্টও কি হারিয়ে যাচ্ছে না? অনেকের কার্যক্রম চলছে রাডার ছাড়া জাহাজের মতো। তারা জানে না ঠিক কোথায় পৌঁছাতে চায়! তাদের এমন গন্তব্যহীন, অদক্ষ ও অপরিকল্পিত কাজকর্ম অনেক সময়ই আমাদের পীড়িত করে, কিন্তু বিস্ময়করভাবে আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে তেমন উদাসীন!

শুক্রবার জুমার নামাজের আগে ইমাম সাহেবের বয়ান শুনে ভাবি, আজ থেকে আর কখনো নামাজ মিস দেব না। অথচ আছরের নামাজের সময় হতে না হতেই সে প্রতিজ্ঞা ভুলে যাই কিংবা চমত্কার কথা বলেন এমন মোটিভেশন স্পিকারের একটা সেশনে অংশ নিয়ে ভাবি আজ থেকে জীবনটা বদলে ফেলব। কেউ আর আমাকে ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু মিলনায়তন থেকে বের হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর আর সেটা খেয়াল থাকে না!

এক্ষেত্রে অসংখ্য উপাদান প্রভাব বিস্তার করে। তবে প্রযুক্তিপণ্যের আকস্মিক বিস্তার বোধহয় সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের করণীয়, দায়িত্ববোধ, সিডিউল বহু কিছু ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে। অনেকে বহু চেষ্টা করেও পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে পারছে না। ফলে যতক্ষণ জেগে থাকে তারা থাকছে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত! আর এমন অবসাদগ্রস্ত একজন মানুষকে দিয়ে বড় কোনো লক্ষ্য অর্জন কি আদৌ সম্ভব?

মাঝেমধ্যে ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলার খবর পড়ে আঁৎকে উঠি। কিন্তু প্রত্যেকের হাতে (বহুলাংশে অপ্রয়োজনীয়ভাবে) অত্যাধুনিক ফিচারসমৃদ্ধ প্রযুক্তিপণ্য তার চেয়েও ভয়ংকর প্রভাব ফেলছে। আগ্নেয়াস্ত্র বা বিষের চেয়েও ভয়ংকর বস্তু আমরা নির্বিচারে হাতে তুলে নিচ্ছি, সন্তানদের হাতে দিচ্ছি। জেনে হোক বা না জেনে কেউ বিষ পান করে তবে তার ক্রিয়া হবেই। ভিকটিম ওই বস্তুর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানত কিনা—তা রেজাল্টের ক্ষেত্রে পার্থক্য সৃষ্টি করে না।

বিশেষত, কিশোর ও তরুণদের অস্থিরতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাদের কোনো কাজে মন বসছে না; পড়ালেখা ভালো লাগছে না। জীবনকে সমৃদ্ধ করার স্তরে তারা বড় বেশি উদাসীন থাকছে। অনেকে কঠোর চেষ্টা বা ত্যাগ ছাড়াই ‘স্টার’ হতে চাইছে। বাস্তবতা তাদের ধারেকাছে ভিড়তে পারছে না। মা-বাবার অসহায়ত্ব প্রকাশ ছাড়া কিছুই করার থাকছে না। অসংখ্য প্রলোভন তাদের কঠোর পরিশ্রমের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

আগের দিনে খেলাধুলা, আড্ডা, পড়ালেখা সবকিছুতে অন্য মানুষের সঙ্গে মিশতে হতো। ফলে পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা ছিল সর্বজনগ্রাহ্য। যেকোনো কাজ করার ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে করার মানসিকতা থাকত। এখন তারা একা একা বড় হয়। ফলে অন্যদের সঙ্গে মিলে কাজ করার দক্ষতার ঘাটতি রয়ে যায়। একাই সবকিছুতে অবদান রাখতে চেষ্টা করে। অন্যদের সঙ্গে নেয়া বা অন্যের সঙ্গে মেশার দক্ষতা কমছে।

কিন্তু সৃজনশীল যেকোনো কাজ হয় সমন্বিত উদ্যোগে। অনেক পক্ষ নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করতে থাকলে তবেই সফলতা আসে। মহৎ সৃষ্টি হরহামেশা হয় না। এমনকি স্টিফেন স্পিলবার্গের ছবিও মাঝেমধ্যে ফ্লপ হয়। আমির খানের সর্বোচ্চ উজাড় করে দেয়া মুভিও দর্শক সেভাবে গ্রহণ করে না! হলিউড-বলিউডে প্রত্যেক সেক্টরের সেরা প্রতিভাবানদের (গল্পকার, সংগীতজ্ঞ, অভিনেতা ইত্যাদি) দিয়ে একেকটা সিনেমার কাজ হয়।

অথচ হালের ভার্চুয়াল স্টাররা নিজেই লেখে, নির্দেশনা দেয় এমনকি পরিচালনা করে। তারা আবার অভিনয়ও করে! মাঝেমধ্যে ভাবি, তারা বুঝি নিজেকে হুমায়ূন আহমেদের চেয়েও প্রতিভাবান বলে গণ্য করে। কারণ তিনি অন্য সব কাজ করলেও কখনো অভিনয়ের দুঃসাহস দেখাননি। এরা অবলীলায় সেটাও করে যাচ্ছে!

একজন মানুষের মাথা থেকে অবিরত এমন সৃজনশীল আইডিয়া আসা সম্ভব নয়, যা দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা যায়। আর সে কারণেই কয়েক বছর আগে দেশের যে ইউটিউবার শীর্ষে ছিল এখন তাকে সেরা ১০-এর মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ প্রতিদিন দর্শকের সামনে অসংখ্য বিকল্প আসছে। সেখানে একই ব্যক্তির, একই ঢঙের কাজ বারবার দেখার রুচি থাকবে কেন?

তাই দীর্ঘমেয়াদে নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তোলার ও শ্রম দেয়ার মানসিকতা না থাকলে এ-পথে না হাঁটাই ভালো। নিজেকে একটা ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা দু-চার মাস বা বছরের ব্যাপার নয়। যুগের পর যুগ চেষ্টা করে যেতে হয়। এমনকি আমৃত্যু লেগে থাকতে হয়।

তবে হ্যাঁ, আশার কথা হলো—ব্যাপারটা এমন নয়, বহু বছর পর একসঙ্গে রিটার্ন পেতে শুরু করবেন, বরং প্রতিদিন আপনি যে চর্চাগুলো করতে থাকবেন তা আপনাকে ছোট ছোট ফেভার করবে। যা আপনার সফলতা অর্জনে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে। আর তাই সেগুলোর কিউমিলিটিভ ইফেক্ট অনেক বেশি হবে। ফলগুলো যখন চোখের সামনে দেখতে পাবেন তখন তা আপনাকে আরো বেশি ডেডিকেটেড হতে সাহায্য করবে।

তাই যখন যেটুকু পড়বেন, নতুন যা শিখবেন সেটা যদি প্রয়োগ করার সুযোগ আসে তখন সেটা করবেন। তাতে আপনি নগদে ফল পাবেন। আরো চর্চা করতে উৎসাহ পাবেন। ব্র্যান্ডিংয়ের পথে সফলতা আপনাকে আরো বেশি কমিটেড, ডেভোটেড ও ডেডিকেটেড হতে উৎসাহ দেবে।

এবার আসি শুরুতে বলা সেই রাজার কথায়। আসলে আপনার ক্রেতা-ভোক্তা-দর্শকই হলো সেই রাজা। তারা কী চায়, নিজেরাও জানে না (The public do not know what is possible but we do. — Akio Morita)। কিন্তু আপনার হাজির করা পণ্য যদি তাদের পছন্দ না হয় তবে তারা মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর সেটা আপনার গর্দান যাওয়ার শামিল। কারণ আপনি আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন না।

তাই নিরন্তর চেষ্টা থাকতে হবে নিজের মানোন্নয়নের পাশাপাশি তাদের মনোভাব ও প্রত্যাশা অনুভবের। সেটা ঠিকমতো করতে পারলে মিলবে অজস্র ইনাম ও বাহবা!

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও সেলফ ব্র্যান্ডিং সংক্রান্ত ‘ভাইরালের ভাইরাস’ বইয়ের লেখক। উৎস : বণিকবার্তা, পহেলা নভেম্বর ২০২২।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *