মনে করুন, পরিবারের সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে গেলেন। তিনদিনের ট্যুর। সেখানে মোট কত ছবি তুলবেন? একশ, পাঁচশ নাকি তারও বেশি? পরিবারের সব সদস্যের ফোন ও ক্যামেরা মিলিয়ে কমপক্ষে এক হাজার হবে, তাই না?
অথচ আমাদের শৈশবে ক্যামেরার একটা ফিল্ম কিনলে তেত্রিশের কাছ চৌত্রিশটা ছবি হলেই নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হতো! তখন একটা ছবি তোলার আগে কতবার ভাবা হতো। আর একবার সেটা তোলার পর অবশ্যই প্রিন্ট করা হতো। এমনকি সেগুলো থেকে দু-একটা আবার বাঁধাই করে দেয়ালে টানিয়ে রাখা হতো। অথচ এখন আমরা কী করি?
আপনি যে ছবিগুলো তোলার ব্যস্ততায় সাগরের গভীরতা অনুভব করা থেকে বঞ্চিত হলেন কিংবা অনেকের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেন, সেই সব ফটো কি পরবর্তী সময়ে একবারো মনোযোগ দিয়ে দেখেন?
সর্বশেষ যেখানে ঘুরতে গিয়েছিলেন সেখানকার ছবিগুলোর রিভিউ শেষ করেছেন? হয়তো কয়েকটা ছবি ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করার পর আপনি নিজেও সেগুলোর কথা ভুলে গেছেন। অথচ সেই ছবিগুলো তোলার জন্য কতই না চমৎকার মুহূর্ত হাতছাড়া হয়েছে!
বহু মানুষ আজকাল নয়নাভিরাম কোনো দৃশ্য সরাসরি নিজের চোখে দেখে না। ক্যামেরা বা ফোনের স্ক্রিনের মাধ্যমে দেখে আর ছবি তুলতে থাকে! মাঝেমধ্যে ভাবি, সব যদি স্ক্রিনেই দেখবে তবে পয়সা খরচ করে, ধকল সয়ে সেখানে যাওয়ার দরকার কী? ইউটিউবে দেখলেই হয়!
এটা শুধু আমজনতার ক্রেজ নয়। বরং ফিফার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো কিংবদন্তি খেলোয়াড় পেলের কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে সেলফি তোলায় হয়েছেন বিতর্কিত! ক’দিন আগে বাইডেন সাহেবের সেলফি নিয়ে কত আলোচনাই না হলো! অথচ তাদের ফটো তোলার জন্য তো চারপাশে অসংখ্য পেশাদার লোক ছিল।
ইদানীং দেখছি, বহু প্রতিষ্ঠানের টপ বস সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজের ফোনে ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ সেগুলো তেমন কোনো কাজে লাগে না। প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যানের ছবিই কিন্তু মিডিয়ায় যায়। তাহলে তার পরও সংশ্লিষ্টরা নিজেকে সংবরণ করতে পারেন না কেন?
এক্ষেত্রে একটি বিষয় ভাবুন। কোনো পার্ক বা পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরতে যাওয়ার সময় কি আমরা কেউ চিপস, বাদাম, আচার, চটপটি বা ফুচকা কিনে খাওয়ার টার্গেট নিয়ে বাসা থেকে বের হই? না, সাধারণত সেটা করা হয় না। কিন্তু সেসব স্থানে যাওয়ার পর প্রায় সবাই সেগুলো কিনে খাই। কেন এমনটা হয়?
কারণ অন্যদের খেতে দেখে বা সুন্দরভাবে সেগুলো সাজানো দেখে খাওয়ার আগ্রহ জাগে। তখন সঙ্গে থাকা একজন ব্যক্তি মুখ ফুটে সেটা প্রকাশ করলেই অন্যরা তাতে সম্মতি দেয়। কারণ তাদের ভেতরেও পণ্যটি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই তীব্র হচ্ছিল।
ঠিক তেমনিভাবে আজকাল ছবি তোলাও সংক্রামক হয়েছে। নিজের অজান্তেই হাতের শক্তিশালী ক্যামেরাসমৃদ্ধ ফোনটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেই ছবি আদৌ কোনো কাজে লাগবে কিনা তা ভেবে তেমনটা করা হয় না।
আবার প্রতিদিন কত শত সংবাদ পড়ি, ভিডিও দেখি, সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের কর্মকাণ্ড দেখতে থাকি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে সেগুলোয় কতটুকু মনোযোগ দিই বা আমরা গ্রহণ করি? অযথা সময় নষ্ট করার পর অনেকেই বুঝি। নিজেকে সংযত করার প্রতিজ্ঞা করি। তার পরও কেন যেন আবার সেগুলোর পেছনেই সময় নষ্ট হয়!
কারণ সেগুলো অনায়াসে বারবার চোখের সামনে আসে। অন্যদের দেখাদেখি, আলোচনা এবং সহজলভ্য হওয়ায় আমরা ‘না’ করতে পারছি না। আর শুধু সে কারণেই নিত্যদিন আমাদের মস্তিষ্কে কত যে অপ্রয়োজনীয় জিনিস ঢোকাচ্ছি তা কি ভাবার সময় পাচ্ছি?
আমার এক স্যারের বড় ভাই যুক্তরাষ্ট্রে নামকরা ডাক্তার। অনেক বছর পর তিনি দেশে বেড়াতে এলেন। তখন স্যারেরও বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। তাই তিনি কথা প্রসঙ্গে খাবার-দাবারের ব্যাপারে ডাক্তার ভাইয়ের পরামর্শ চাইলেন।
তখন তিনি বললেন, হালাল সব জিনিসই পরিমিত মাত্রায় খাবে, তবে একটা জিনিস ছাড়া। স্যার তখন খুব আগ্রহভরে জানতে চাইলেন, সেটা কী জিনিস? তখন ডাক্তার সাহেব ছোট্ট করে বললেন, দাওয়াত!
আমাদের দেশে এক বেলা দাওয়াত খেলে শরীরের ওপর যে অত্যাচার হয় তা সত্যিই কল্পনাতীত। কোনো বাসায় দাওয়াতে গেলে মনে হয় অতিথি বুঝি শুধু খাওয়ার জন্যই সেখানে গিয়েছে। কারণ বহু পদের সবজি, ডিম, মাছ, মাংস খাওয়ানোর পরও হোস্ট অপরাধীর ভঙ্গিতে বলেন, তেমন কিছু করতে পারলাম না!
অথচ ইউরোপ-আমেরিকায় (অবাঙালি) কারো বাসায় বলে কয়ে বেড়াতে গেলেও দেখবেন আপনি যাওয়ার আগে তারা রান্নাবান্না কিছুই করেনি। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু গল্প করবে। চিপস, চা-কফির মতো রেডিমেড জিনিস সামনে রাখবে। পরে রান্নার সময় হলে মেহমানকেও কিচেনে ডেকে নিয়ে গল্পে গল্পে বড় জোর এক থেকে দুটি আইটেম করবে। সঙ্গে সালাদ বা মুখরোচক কিছু যোগ করবে, ব্যস।
অর্থাৎ অনেক দিন পর মানুষটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। ফলে ভাবের আদান-প্রদানই তো আসল, তাই না? অথচ আমাদের দেশে একজন মেহমানের আপ্যায়নের জন্য বাসার কয়েকজন মানুষ বেলাভর গলদ্ঘর্ম হতে হয়!
পোশাকের ক্ষেত্রে আমাদের শৈশবে হিসাব ছিল খুব সহজ। স্কুল ড্রেস বাদে শখের পোশাক পাওয়া যেত রোজার ঈদে। কোরবানির ঈদে কিছু পেলেও তার জন্য বেশি বরাদ্দ থাকত না। বছরের অন্য সময়ে পরিবারে বিয়ের মতো উৎসব ছাড়া সাধারণত নতুন পোশাক কেনা হতো না।
অথচ এখন এ বাবদ প্রত্যেক পরিবারে যে ‘অপচয়’ হয়, তা সত্যিই বিস্ময়কর! চাকরিজীবীদের প্রতি মাসে ব্যয়ের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে এ খাতে।
মজার ব্যাপার হলো, বাসায় পোশাক যে হারে ইনপুট হয় সেই হারে কিন্তু আউটপুট হয় না! ফলে ক্রমেই পোশাকের স্তূপ জমতে থাকে। অনেকের বাসায় ছোটখাটো শোরুমের চেয়ে বেশি জামাকাপড় জমে গেছে। তার পরও প্রতি মাসে কিছু কেনা না হলে হাত নিশপিশ করে!
নিজে ব্যবহার করবে না এটা নিশ্চিত হওয়ার পরও অন্যদের সেগুলো দান-সদকা করে না। আবার সেগুলো ফেলেও দেয় না। পুরনোগুলো পরার সুযোগ তো একেবারেই নেই। কিন্তু কথা হলো, এভাবে নিত্যনতুন পোশাক কেনার ক্ষমতা বাড়লেও আগে ঈদের একটা ড্রেস/জামায় যে তৃপ্তি হতো এখন কি তা হয়?
সন্তানদের পড়ালেখার বিষয়ে কিছু মা-বাবা তো রীতিমতো ক্রাইম করছেন! সন্তানদের শৈশবকে নির্মমভাবে হত্যা করছেন। তাদের স্কুলের পড়ালেখার বাইরে কোচিং, প্রাইভেট, অনলাইনে কোর্স, গাইড-নোটবুক, হ্যান্ডনোট ইত্যাদি দিয়ে পড়ালেখাটা সন্তানদের কাছে রীতিমতো ভীতিকর করে তুলেছেন।
অথচ আমাদের শৈশবে এগুলোর বালাই ছিল না। বছর শেষে যেদিন রেজাল্ট বের হতো শুধু মা-বাবা নয়, পুরো পাড়ার মানুষ খুশি হতো। অথচ এখন এত কিছু করার পরও সন্তান অংকে কেন ২ নম্বর কম পেল, সেই দুঃখে মা অন্যদের কাছে মুখ দেখাতে পারেন না! সন্তানের ৯৯ শতাংশ নম্বর পাওয়ার কৃতিত্ব তাদের তৃপ্ত করতে পারে না।
এক অসহায় বাবা ফল প্রকাশের দিন ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া সন্তানকে রক্ষার উপায় জানতে চাইলেন। তখন ছেলেটাকে শিখিয়ে দিলাম, এর পরে এটা নিয়ে তোমার মা রাগারাগি করলে তাকে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করবে, তিনি ক্লাস থ্রিতে পড়াকালে অংকে কত নম্বর পেয়েছিলেন?
জবাবে তিনি নাকি বলেছেন, আমার সময় এত সুযোগ-সুবিধা ছিল নাকি?দুঃখজনকভাবে সন্তানদের অর্জনের মাত্রা বাড়লেও আমাদের মন তৃপ্ত হচ্ছে না। বিষয়টা সত্যিই উদ্বেগজনক, তাই না?
আগের দিনে সত্যিকারের ডাক্তারের সেবা পাওয়া সহজ ছিল না। ফলে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ হাতুড়ে ডাক্তার, কবিরাজ ও হোমিও চিকিৎসা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকত। এখন তাদেরও আধুনিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণের সুযোগ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, অসংখ্য টেস্ট, ডজন ডজন ওষুধ, সব মিলিয়ে আধুনিক মেডিকেল সেবা পাচ্ছেন।
তার পরও অধিকাংশ পরিবারে রোগবালাই লেগেই রয়েছে। প্রতি মাসে কয়েকটা দিনও তারা সত্যিকারের সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন না! তার মানে এত আধুনিক চিকিৎসাসেবাও আমাদের সুস্থ রাখতে পারছে না।
তাছাড়া আগের দিনে এত জটিল-কঠিন রোগের নামও শোনা যেত না, এত ঘন ঘন শরীর খারাপের কথাও কেউ বলত না। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের মাত্রা বাড়লেও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষের সংখ্যা কমছে।
আর বিনোদনের তো কথাই নেই। আগের দিনে সাপ্তাহিক নাটক বা মাসে একটা সিনেমা দেখার জন্য সবাই পাড়ার একমাত্র সাদাকালো টিভির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। দূর-দূরান্তে যাত্রাপালা বা মঞ্চনাটক দেখতে যেত। হাতের কাছে বিনোদনের জন্য ছিল ছোট্ট রেডিও।
তরুণরা কালেভদ্রে সিনেমা হলে গিয়ে দু-একটা দেখার সুযোগ পেত। অথচ সেগুলোতেই মানুষের তৃপ্তির মাত্রা ছিল সীমাহীন। অনেকে একটা সিনেমা একবার দেখার পর সেই গল্প শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলতে পারত। কেউ কেউ স্মৃতি থেকে সেই সিনেমার গান পুরোটা গাইতে পারত। অর্থাৎ সামান্য যে বিনোদনের সুযোগ ছিল তা মানুষ পুরোপুরি উপভোগ করত।
অথচ এখন আমরা বিনোদনের মধ্যে বসবাস করছি। দিবা-রাত্রি ইচ্ছমতো পছন্দের গান, নাটক, সিনেমা উপভোগ করছি। কিন্তু সেই তৃপ্তিটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে!
প্রাত্যহিক জীবনে ধর্মকর্ম মেনে চলা লোকের সংখ্যা চারপাশে অনেক বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় সমাজে দুর্নীতি কমেনি। লুটপাট বা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। ধর্মে অনুরক্ত হওয়ার প্রকাশ ও পোশাক যতটা বেড়েছে অন্তরের কালিমা সম্ভবত সেই মাত্রায় দূর হয়নি। ফলে বাহ্যিক অবয়বের সঙ্গে কাজকর্ম মিলছে না।
হয়তো সে কারণেই মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, It is better in prayer to have a heart without words than words without heart. যেখানে হৃদয়ের সত্যিকারের আকুতি অনুপস্থিত সেখানে আনুষ্ঠানিকতা বা উচ্চারিত শব্দগুলো খুব বেশি কি গুরুত্বপূর্ণ?
যা-ই হোক, আমাদের অধিকাংশের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে ভোগের মাত্রা ও প্রবণতা। কিন্তু ভোগ যে মাত্রায় আমাদের তৃপ্ত করবে প্রত্যাশা ছিল, বাস্তবে তা হয়নি। বরং ভোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অতৃপ্ত হৃদয়ের হাহাকারও বাড়ছে।
তাহলে ঠিক কীসের জন্য আমরা অন্যায়-দুর্নীতি-জুলুম করে হলেও নিজেদের ভোগের সামর্থ্য বাড়াতে চাইছি? ‘অল্পে তুষ্ট থাকা’র নীতি বিসর্জন দেয়াই কি এই সংকটের মূল কারণ ?
ড. মো. আবদুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘সুখের অসুখ’ বইয়ের লেখক। উৎস: বণিকবার্তা, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
শেয়ার করুন